রাশিয়া কি এখন এমন কারও নেতৃত্বে আছে, যে যথাযথ কারণ ছাড়াই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেবে? ভ্লাদিমির পুতিন ইতিমধ্যেই ইউক্রেনকে নিয়ে বেশ কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে, যা আমাদের উপরের প্রশ্নে ইতিবাচক উত্তরের দিকে ঠেলে দেবে।
ইউক্রেন আক্রমণের একদিন আগে রাশিয়া এবং তার মিত্র বেলারুশ পারমাণবিক মহড়ার আয়োজন করে। ইউক্রেনে আক্রমণের ঘোষণার সাথে সাথে পুতিন সুনির্দিষ্ট ভাবে উচ্চারণ করেন যে রাশিয়া পারমাণবিক শক্তিতে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশ।
পারমাণবিক হুমকি
ইতিপূর্বে পুতিন যদিও ‘রাশিয়ায় সরাসরি আক্রমণ’ হলেই কেবল পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করবেন বলে জানিয়ে এসেছেন। তবে ইউক্রেন আক্রমণ প্রসঙ্গে তিনি এ-ও বলেছেন, যারা তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ইতিহাসের সবথেকে বড় বিপর্যয়।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং নোভোয়া গেজেটা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভ বিশ্বাস করেন, “পুতিনের শব্দচয়নকে মনে হয়েছে পারমাণবিক যুদ্ধের সরাসরি হুমকি।”
ভয় থেকেও রাশিয়া অগ্রিম কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। রাশিয়া, গত ২১ ফেব্রুয়ারী, নিজ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে জানায়, ইউক্রেনের নেতৃত্ব নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে। উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়, যখন গত ২৭ ফেব্রুয়ারী পুতিন রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনীতে রেড এলার্ট জারি করে। যার কারণ ছিল ন্যাটোর এক কর্মকর্তার রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য।
ভ্লাদিমির পুতিন যদি পারমাণবিক বোমাকে বিকল্প হিসেবে বেছে নেন, তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে কেউ কি তাকে বুঝিয়ে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করবে, থামানোর চেষ্টা করবে? দিমিত্রি মুরাতভ বলেন, রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী কখনোই জনগণের পক্ষ নেয় না। তারা সবসময় শাসকদের পক্ষে।
আর ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়াতে শাসকই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাশিয়া এমন একটি দেশ যেখানে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। সেখানে ক্রেমলিনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
পুতিনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সেখানে কেউই প্রস্তুত নন। পৃথিবী এখন এক বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছি। ইউক্রেন যুদ্ধ, ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধ। ক্রেমলিনের নেতা যদি তার অভীষ্ট সামরিক লক্ষে পৌঁছাতে সফল হন, সেক্ষেত্রের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ সন্দেহের মুখে পড়বে। তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন যদি এরকম কোন উপলব্ধি তৈরি হয় এবং তিনি যদি মারাত্মক হতাহতের সম্মুখীন হন, সেক্ষেত্রে আশংকা হচ্ছে ক্রেমলিন মরিয়া কোন পদক্ষেপ নিয়ে ফেলবে কিনা।
রাশিয়ার যুদ্ধনীতি
রাশিয়া কীভাবে কখন কেন তার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে, এটা এখন বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নে আলো ফেলানো যায় কৌশলগত ও আধা-কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের মধ্যকার পার্থক্য দেখিয়ে।
কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের দুইটা প্রধান ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত, এরা আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে কাজ করে। যখন অস্তিত্ব ঝুঁকিতে পড়ে অর্থাৎ অন্য কোন পারমাণবিক শক্তিধর দেশ যদি আক্রমণ করে, তবে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয়ত, সংঘর্ষ থেকে শক্তিশালী দেশগুলোকে দূরে রাখা। যাতে করে রাশিয়া তার অভিযান সচল রাখতে পারে।
আধা-কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র অন্যদিকে রাশিয়ার সামরিক নীতিতে পরিবর্তনশীল এক ভূমিকা রাখে। অনেক রাশিয়ান যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা, সীমিত পারমাণবিক শক্তি প্রয়োগকে যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব হিসেবেই দেখে। ন্যাটো তার মিত্রদের লড়াইয়ের গতিপথ বদলাতে সাহায্য করলে, এটা তার স্রোত রাশিয়ার দিকে নিয়ে আসবে।
রাশিয়ার সামরিক চিন্তাভাবনার আরও দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথমত, রাশিয়া যুদ্ধকে চার ভাগে ভাগ করে। এর মধ্যে একটি হলো সীমতি পর্যায়ে যুদ্ধ, যার মধ্যে আছে সিভিল ওয়ার। এছাড়া স্থানীয়, প্রাদেশিক ও বড় পর্যায়ের যুদ্ধ আছে। প্রাদেশিক ও বড় পর্যায়ের যুদ্ধেই রাশিয়া সাধারণত সর্বশক্তি প্রয়োগের কথা ভাবে।
দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী যুদ্ধের তীব্রতা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধির নীতিতে কাজ করে। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার এসব পর্যায়ের অনেক শেষে আসে। দুইক্ষেত্রেই পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের জন্য শেষ অব্দি অপেক্ষা করতে হবে।
ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার
পারমাণবিক অস্ত্রের কথা উল্লেখ করে মস্কো মূলত, ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমাদের প্রভাব কমাতে চায়। যাতে রাশিয়ার প্রভাব আরও বেশি কার্যকর হয় ইউক্রেনে। পশ্চিমাদের এই যুদ্ধে প্রধান অস্ত্র এখন সামরিক নয়, বরং নিষেধাজ্ঞা। কারণ যদি নিষেধাজ্ঞা প্রকৃত অর্থেই রাশিয়ার অর্থনীতিকে ভেঙে দেয় এবং অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাকে ধ্বসিয়ে দেয়, তাহলে রাশিয়ার শাসকেরা হয়তো যেকোন মূল্যে ইউক্রেন দখলের ঝুঁকি বুঝতে পারবে।
আবার এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের প্রতিরোধ ভাঙতে সীমিত পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার একদম অসম্ভব নয় রাশিয়ার পক্ষে। তাই পশ্চিমাদের এইসব নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হওয়া উচিত, রাশিয়ার যুদ্ধ থামানো, পুতিনের শাসনের ভীত নাড়ানো নয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি কতটা, তা যেমন পুতিনের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে, তেমন নির্ভর করছে পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার লাগাম টানার উপরও।
তবে রাশিয়ার সামরিক নীতিতে এই যুদ্ধ এখনও, স্থানীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে আছে। ইউক্রেনের প্রতিরোধ ভাঙতে এ পর্যায়ে রাশিয়া সামরিক বাহিনী ও সাধারণ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়াবে সামরিক বেসামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে।
তবে একটু যদি সামনের দিকে অগ্রসর হই, পুতিন পুরোদমে ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী তা কঠোরভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে, ক্রেমলিনকে অবাক করে দিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলার মতো অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব।
এ পরিস্থিতিতে মস্কো ভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ পাভেল ফেলজেনহাওয়ার জানান, পুতিন খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। তার সামনে তেমন কোন পথ খোলা নেই। পশ্চিমা বিশ্ব যদি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দ করে ফেলে, সেক্ষেত্রে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতন হবে।
সেক্ষেত্রে রাশিয়ার জন্য একটি উপায় হতে পারে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া। আর একটি বিকল্প হতে পারে ব্রিটেন এবং ডেনমার্কের মাঝামাঝি নর্থ সি’র কোন এক যায়গায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, তাতে কী ঘটে সেটা পর্যবেক্ষণ করা।
তাছাড়া এখনি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ভেবে নেয়ার কারণ নেই। আমেরিকার ধারণা অনুযায়ী, রাশিয়া রাসায়নিক ও জৈবিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ইউক্রেনকে পরাজিত করতে রাশিয়ার মূলত অস্ত্রের অভাব নেই।
[‘দ্য কনভার্সেশন’ থেকে অনুবাদ করেছেন শুভ্র সরকার]
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৭
আপনার মতামত জানানঃ