অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। মাঝেমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানের মুখে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও থামানো যাচ্ছে না শরণার্থী ক্যাম্পের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অপরাধ তৎপরতা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন কোনো না কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অস্ত্র উদ্ধার, ইয়াবা ব্যবসা, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও অনিয়মতান্ত্রিক কাজে রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এক সপ্তাহে অস্ত্র-গুলি ও ইয়াবাসহ ১২ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টেকনাফের তুলাতলি, কেরুনতলী এলাকা ও উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ছয়জন এবং উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে ছয়জনকে আটক করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও জেলা পুলিশ।
৮ এপিবিএন এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) কামরান হোসেন জানান, ১৭ ফেব্রুয়ারি বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ১ লাখ ৬৯ হাজার ইয়াবাসহ এক রোহিঙ্গা যুবক ও ২৩ ফেব্রুয়ারি একই ক্যাম্প সংলগ্ন নৌকার মাঠ পাহাড়ের নিচ থেকে অস্ত্রসহ তালিকাভুক্ত পাঁচ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এক সপ্তাহে অস্ত্র-গুলি ও ইয়াবাসহ ১২ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
১৬ এপিবিএন এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম জানান, ১৯ ফেব্রুয়ারি উনচিপ্রাং ক্যাম্প থেকে অস্ত্র-গুলিসহ তিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, ২০ ফেব্রুয়ারি কেরুনতলী এলাকা থেকে একটি রোহিঙ্গা ডাকাত দলের প্রধান এবং ২২ ফেব্রুয়ারি তুলাতলি এলাকা থেকে ২ হাজার ইয়াবাসহ দুই রোহিঙ্গা নারীকে আটক করা হয়েছে।
জানা যায়, গত চার বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড।
অভিযোগ উঠেছে, এখানে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকার ইয়াবার লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সব ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নাকি এসব ক্যাম্প থেকেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি; আসামি ছিল ১৫৯ রোহিঙ্গা। অথচ চলতি বছর মাত্র ছয় মাসেই ৫৬৭টি মামলায় রোহিঙ্গা আসামির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারে রয়েছে চার শতাধিক রোহিঙ্গা। মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িয়ে এদের অনেকে বিপুল অর্থসম্পদের মালিকও হয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের দাবি, অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেই অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সক্রিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর বাইরে ক্যাম্পকেন্দ্রিক রয়েছে আরও একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোতে দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলেও রাতে তা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩৪৩
আপনার মতামত জানানঃ