আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠছে, এই নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাবনা কতটা। আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রমের বাইরে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৭ সাল থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দল এতো দীর্ঘসময় কখনো ক্ষমতার বাইরে থাকেনি।
বর্তমান বিএনপি এতিম, অসহায় ও সহায়-সম্বলহীন দল। নেতারা প্রতিনিয়ত বিএনপিকে বিক্রি করছেন বেঁচে থাকার জন্য। দলের নেতৃত্ব কার হাতে কেউ জানেন না সঠিকভাবে। রিজভী নিজেকে মহাসচিব ভাবেন। মির্জা ফখরুল রিজভীকে সহ্য করতে পারেন না। যেন সতীনের সংসার করছে বিএনপি।
১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পরপর চারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল ও সব দলের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। তবে বদলে গেছে পরিস্থিতি। বিলুপ্ত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি অলৌকিক ভাবেই টিকে আছে। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয় বিএনপির। দলটির ক্ষমতায় আসতে ঘটতে হবে অলৌকিক কিছু।
বিএনপি তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল। প্রথম দফায় ১৯৭৮ (১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বরের আগে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকলেও বিএনপি ছিল না) থেকে ১৯৮২ সাল। দ্বিতীয় দফায় ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল। তৃতীয় দফায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আশির দশকে বিরোধী দলে থাকতেই বিএনপি সুবর্ণ সময় পার করেছে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করার পর বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। সেই কঠিন সময়ে খালেদা জিয়া দলীয় প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। দলকে সংগঠিত করেছেন। বিএনপির নতুন প্রজন্মের অনেক নেতা এসেছেন আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
আওয়ামী লীগের চেয়ে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও খালেদার আপসহীন ভূমিকার কারণে বিএনপি ১৯৯১-এর নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। এমনকি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদেও বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের পর দলটি সেই ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিএনপি গত ১১ বছরে দলীয় ইস্যুতে যত কর্মসূচি পালন করেছে, জনগণের দাবিদাওয়া নিয়ে তার সিকিভাগও করেনি। আর এখন দলটি আন্দোলন করবে কি, নিজেই পথ হারিয়ে ফেলেছে।
ফখরুলের সঙ্গে তারেকের দূরত্ব
দলের অভ্যন্তরে সমন্বয়হীনতা, সিনিয়র নেতাদের ষড়যন্ত্র, খালেদা জিয়াকে অবমুক্ত না করার উদ্যোগসহ বিভিন্ন কারণে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে তারেক রহমানের।
বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, সিনিয়র নেতাদের ছন্নছাড়া অবস্থায় বিএনপি আজ মৃতপ্রায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিএনপির অঙ্গ-সংগঠন থেকে যে অনুদানের টাকা আসে, সেই টাকার ভাগ নিয়েই বিএনপির অভ্যন্তরে মূল গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া দলে মির্জা ফখরুলের একচ্ছত্র আধিপত্য, রাজপথের আন্দোলনের নামে উঠান বৈঠক করা, সভা-সেমিনারে আন্দোলন সীমাবদ্ধ রাখার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে হাসিঠাট্টার পাত্রে পরিণত হয়েছে বিএনপি।
চলছে বহিষ্কারের ধুম
বিএনপিতে একের পর এক বহিষ্কারের নাটক চলছে। সর্বশেষ বহিষ্কৃত হয়েছেন বিএনপির জনপ্রিয় নেতা আখতারুজ্জামান। বহিষ্কারগুলোকে বলা হচ্ছে গঠনতন্ত্রবিরোধী। বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে অন্ধকারে রেখে এ ধরনের বহিষ্কারাদেশ জারি করা হচ্ছে।
বিএনপিতে বহিষ্কার কে করতে পারেন, এ সম্পর্কে গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া রয়েছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী দলের চেয়ারপার্সন। দলের চেয়ারপার্সন যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তিকে দল থেকে বহিষ্কার করতে পারেন।
তবে এই বহিষ্কারাদেশ পরবর্তীতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচিত হতে পারে। কোনো সাংগঠনিক অবস্থার কারণে বিএনপির কোনো নেতাকে বহিষ্কার করতে হলে সে বিষয়টি দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচিত হওয়া দরকার বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এ ধরনের অভিযোগ আসার পর সেটি দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচিত হবে এবং স্থায়ী কমিটি সে সংক্রান্ত চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করবে।
তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বিএনপিতে সাম্প্রতিক সময়ে যে বহিষ্কারাদেশগুলো হচ্ছে সেই বহিষ্কারাদেশের কোনোটি স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করা হচ্ছে না। বহিষ্কার করার ক্ষেত্রে দলের চেয়ারপার্সনের যে ক্ষমতা সেই ক্ষমতারও অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে বলে বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন।
প্রকট হচ্ছে অন্তর্দ্বন্দ্ব
বিএনপিতে কোনো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিধান নেই। দলের চেয়ারপার্সন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। কোনো কারণে যদি চেয়ারপার্সন দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন, তাহলে স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বিধান রয়েছে গঠনতন্ত্রে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময় বিএনপিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, যেটি গঠনতন্ত্রবিরোধী বলে মনে করছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
তারা বলছেন, বিএনপিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কোনো বিধান নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিধান না থাকলেও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়াকে এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে বলা হচ্ছে এবং এই সব বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত তিনি এককভাবে নিচ্ছেন।
জানা যায়, টেলিফোনের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নামের তালিকা ধরিয়ে দিচ্ছেন এবং তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য আদেশ দিচ্ছেন। কেন তাদেরকে বহিষ্কার করা হচ্ছে? তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী? সে সম্পর্কেও কোনো কথা বলা হচ্ছে না।
তৈমুর আলম খন্দকারকে যখন প্রথম দলের বিভিন্ন পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, তখন দলের ভেতরে প্রশ্ন উঠেছিল। তাদের মধ্যে থেকে কেউ বলেছিলেন, তৈমুর আলম খন্দকার এখন নির্বাচন করছেন এই অবস্থায় তাকে দলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়াটা যৌক্তিক হবে না।
তখন বলা হয়েছিল, এটি কৌশলগত একটি অবস্থান। কিন্তু যখন তৈমুর নির্বাচনে পরাজিত হলেন তখন তাকে প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা হল এবং এই বহিষ্কারাদেশও দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আলোচনা হয়নি। তাহলে দল কি এক ব্যক্তির খেয়াল-খুশিমতো চলবে? এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে থেকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, খালেদা জিয়া যখন বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তখন তিনি স্থায়ী কমিটিকে উপেক্ষা করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন না। বরং, স্থায়ী কমিটির মতামতের ভিত্তিতেই বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় চলছে বিএনপি।
স্থায়ী কমিটিকে একটা ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে লন্ডন থেকে দল পরিচালনা করছেন তারেক জিয়া। আর এ কারণেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে স্থায়ী কমিটির আসলে কোনো কার্যক্রম আছে কিনা বা স্থায়ী কমিটির কোনো ক্ষমতা আছে কিনা, এই প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য।
জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ইকবাল মাহমুদ টুকু এবং সেলিমা রহমান এভাবে ঢালাও বহিষ্কারের সুস্পষ্ট বিরোধী।
তারা বলছেন, এভাবে বহিষ্কার করা হলে দল টিকবে না এবং এ ধরনের বহিষ্কারের বিষয়গুলো নিয়ে দলের ভেতর চুলচেরা আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার যেটি হচ্ছে না। আর এ কারণেই ‘বহিষ্কার মহামারি’তে বিএনপির মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ