ভারতের বিজেপিশাসিত কর্ণাটকে হিজাব বিতর্ক ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে ও জটিল হচ্ছে। মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব পরে কলেজে আসতে নিষেধাজ্ঞা জারির পর কোনো কোনো কলেজে হিন্দু শিক্ষার্থীদের গেরুয়া ওড়না বা ‘স্কার্ফ’ পরে কলেজে আসতে দেখা যায়। ছাত্রদেরও গেরুয়া চাদর পরে কলেজে আসতে দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে কোথাও কোথাও উত্তেজনাও দেখা দিয়েছে। যদিও অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর এক টুইট হিজাব বিতর্কে নতুন রাজনৈতিক মাত্রা যোগ করেছে।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাঠ ও মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে গোড়া থেকেই বিজেপি হিন্দু মেরুকরণের কৌশল নিচ্ছে বলে অভিযোগ। কর্নাটকের হিজাব বিতর্ক তাতেই নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তেমনই আগামী বছরের মাঝামাঝি কর্নাটকে বিধানসভা নির্বাচনের আগে হিন্দু ভোটের মেরুকরণের প্রশ্নে এখন থেকেই বিজেপি ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, পরিকল্পিত ওই বিতর্কের ছক অনেক আগেই কষে রাখা হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগে সেই ফাঁদে অজান্তেই মুসলিম ছাত্রীরা পা দিয়েছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরে যাওয়ার বিরোধিতা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে উত্তাল কর্নাটক। মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরে কলেজে ঢোকার সময় এক দল শিক্ষার্থী গলায় গেরুয়া অঙ্গবস্ত্র ঝুলিয়ে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি তুলছেন। রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। মঙ্গলবার থেকেই ওয়েইসি তা নিয়ে উত্তরপ্রদেশে প্রচার শুরু করেছেন। ছাত্রীদের হেনস্থাকারীদের তিনি ‘দুশমন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। মুসকান নামের ছাত্রীটির পাল্টা ‘আল্লা হু আকবর’ ধ্বনির প্রশংসা করেছেন। বুধবার তার মন্তব্য, ওয়েইসি সংসদে দাড়ি, টুপি নিয়ে ঢুকতে পারলে মুসকানরা কলেজে হিজাব পরে কেন ঢুকতে পারবে না? তার দাবি, এ’টি সংবিধান প্রদত্ত ধর্মাচরণের অধিকার।
পাল্টা আক্রমণে বিজেপির আইটি শাখার প্রধান অমিত মালব্যের যুক্তি, ‘হিজাব পরা কবে থেকে আবার সাংবিধানিক অধিকার হল? যারা সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তাদের মনে রাখা উচিত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে সাংবিধানিক অধিকার পালন রুখে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে প্রশাসনের। কর্নাটকে যা হচ্ছে তাতে বলা যায়, ছাত্রীরা ধর্মের নামে পড়াশুনো জলাঞ্জলি দিয়ে হিজাব পরায় বেশি আগ্রহী।’ কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের অভিযোগ, হিজাব পরা নিয়ে জিদ করে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানো হচ্ছে।
দক্ষিণ ভারতের বিজেপি–শাসিত কর্ণাটক রাজ্যে হিজাব বিতর্কের সূত্রপাত হলেও অন্যান্য রাজ্যে তা ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তেজনাও ছড়াচ্ছে। বিতর্ক ছড়িয়েছে পদুচেরি, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানসহ অন্যত্র। আন্তর্জাতিক স্তরেও দেখা দিয়েছে নানারকম প্রতিক্রিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের পর ভারতের সমালোচনা করেছে ইসলামিক দেশগুলোর সংগঠন ‘ওআইসি’। জাতিসংঘেও এই বিতর্কের অনুরণন অনুভূত। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই বার্তা।
হিজাব নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের অতি উৎসাহ বিজেপিকেই বিপাকে ফেলেছে। এটা এতটাই যে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কর্ণাটকের রাজ্য শাখাকে সতর্ক করে বলেছে, এই বিতর্ক যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সৃষ্টি করা নয়, সময় নষ্ট না করে তা সর্বত্র প্রচার করা হোক। সেই সঙ্গে মুসলমান নারীদের বোঝানো হোক, বিজেপি তাদের বিরুদ্ধে নয়। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একই বার্তা বিভিন্ন রাজ্যের নেতাদেরও দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় সংগঠনের এক দায়িত্বশীল নেতা এ প্রসঙ্গে জানান, তিন তালাক আইন ‘শিক্ষিত ও আলোকিত মুসলমান নারীদের’ মধ্যে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। হিজাব বিতর্ক তা নষ্ট করে দিতে চলেছে। হিজাব বিতর্ককে তিনি ‘অনাবশ্যক’ বলেও অভিহিত করেন।
হিজাব নিয়ে কর্ণাটক হাইকোর্টে মামলার শুনানি গতকাল বৃহস্পতিবারও অব্যাহত ছিল। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল সরকারের পক্ষের বক্তব্য জানাতে এক দিন বাড়তি সময় চান। আজ শুক্রবার তা জানাবেন জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি কিছু নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। আবেদনকারীদের অন্যতম আইনজীবী বিনোদ কুলকার্নি বিচারপতিদের অনুরোধ করেন, প্রতি শুক্রবার এবং রমজান মাসে ছাত্রীদের যেন হিজাব পরার অনুমতি দেওয়া হয়।
প্রধান বিচারপতি বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে জানান। আলোচনার মাধ্যমে বিতর্কের মীমাংসার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। জবাবে প্রধান বিচারপতি ঋতুরাজ অবস্থি বলেন, আপনারা সেই চেষ্টা করতে পারেন। তবে বিষয়টির সঙ্গে সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া সমঝোতার জন্য দুই পক্ষের সহমত হওয়া জরুরি।
কর্ণাটকের রাজ্যনেতাদের বলা হয়েছে, অবিলম্বে তারা যেন এই প্রচার শুরু করেন যে হিজাব–সম্পর্কিত নির্দেশে রাজ্য সরকারের কোনো হাত ছিল না। নির্দেশ দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারাই। রাজ্য সরকারের এ ক্ষেত্রে কিছুই করার ছিল না। কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছেন, এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে রাজ্যের শিক্ষিত ও মননশীল মানুষের মন বিজেপি সম্পর্কে বিষিয়ে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বিষয়টির ব্যাখ্যা করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুসলমান নারীদের ক্ষমতায়নে বিজেপি সুচিন্তিতভাবে কয়েক বছর ধরেই কাজ করছে। যেমন তিন তালাক প্রথা নিষিদ্ধ আইন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুসলমান নারীদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট। এ কারণে মুসলমান নারীদের মধ্যে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। কিন্তু অনাবশ্যক হিজাব বিতর্ক সেই ইতিবাচক পরিস্থিতি নষ্ট করে দিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মুসলমান নারীদের শিক্ষার আলোয় নিয়ে যেতে আগ্রহী। কিন্তু প্রচার হচ্ছে, মুসলিম নারীদের শিক্ষা ও হিজাবের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হচ্ছে।’
বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী নিজেই নাকি এই বিতর্কে বিরক্ত। উত্তর প্রদেশের অধিকাংশ আসনে ভোট গ্রহণ এখনো বাকি। বিজেপির ধারণা,হিন্দু মেরুকরণে এই বিতর্ক সহায়ক হচ্ছে না; বরং বিজেপির প্রতি সহানুভূতিশীল মুসলিম নারীদের বিমুখ করে তুলছে।
কর্ণাটকে আগামী বছর মে মাসে রাজ্য বিধানসভার ভোট। সেই রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যার হার ১৩ শতাংশের কম। মূল লড়াই প্রধানত বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের। তৃতীয় শক্তি জনতা দল (এস)। ওই বছরেই ভোট হবে মোট নয়টি রাজ্যে যেগুলোর মধ্যে কর্ণাটক ছাড়াও রয়েছে ছত্তিশগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার মতো বড় রাজ্য।
বিজেপি নেতৃত্বের আশঙ্কা, এই বিতর্ক রাজ্যে বিজেপি–বিরোধী শক্তিগুলোকে জোটবদ্ধ হতে অনুঘটকের কাজ করতে পারে। বিজেপি মনে করছে, পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ড ও গোয়ায় কংগ্রেস সরকার গড়লে কর্ণাটকে তাদের হাল খারাপ হতে পারে। হিজাব বিতর্ক থেকে বিজেপি তাই হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে
এসডব্লিউ/এসএস/১০৫৫
আপনার মতামত জানানঃ