খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাজনৈতিকভাবে সীমিত পরিসরে সমাবেশ, বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করলেও কার্যত কোনও জোরালো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি বিএনপি। এমনকি তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ও এজন্য বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতেও দলটি কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেয়নি। বরং বিষয়টিকে প্রতিবারই ‘পারিবারিকভাবে’ দেখা হচ্ছে, বলে জানিয়েছেন নেতারা।
যদিও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে দলের নেতারা বারবার বলতেন, নেত্রীকে নাকি তারা কখনো কারাগারে যেতে দেবেন না। অবশেষে ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি ঠিকই খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেন। অথচ বিএনপির নেতারা বসে ছিলেন হাত গুটিয়ে।
এরপর বিএনপি নেতারা বললেন, তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে তারা নেত্রীকে কারাগার থেকে বের করবেন। সেটিতেও তারা ব্যর্থ। বর্তমানে শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়া মুক্তি পেলেও, মুক্তি পান সরকারের অনুকম্পায়। অথচ বিএনপি নেতারা ফাঁকা বুলি আওড়ানো ছাড়া কিছুই করতে পারেননি। কিন্তু এর কারণ কী? কেন এই লাগাতার ব্যর্থতা? কেন গড়ে ওঠেনি কোন আন্দোলন?
খালেদা জিয়া কি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার?
১/১১ পরবর্তী সংকট থেকে খালেদা জিয়া কার্যত বিএনপিকে আর বের করে আনতে পারেননি। ২০১৪ সালের বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের পরে তিনি শেখ হাসিনার মত আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে পারেননি।
অধিকাংশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়ে যাওয়ার পর জামায়াত জোটে নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। খালেদা বুঝতে পারেন গণতন্ত্রের জন্য নয়, সুবিধাবাদী জামায়াত বিএনপির জনসমর্থনের শক্তিকে ব্যবহার করেছে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শনাক্ত তাদের দলীয় ব্যক্তিদের রক্ষা করার জন্য। জামায়াতের কৌশল বোঝার ব্যর্থতার চরম মাশুল দিতে হয় বিএনপিকে।
সরকারের প্রবল চাপের মুখে পড়ে দল অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় খালেদা চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। অনেকে ভেবেছিলেন তিনি হয়ত আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু খালেদা দেশে ফিরে এসে তার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির মামলার রায় মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, যে দলের পেছনে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করেছেন, যাকে অবলম্বন করে জিয়া নিহত হওয়ার পর দলটি এত দীর্ঘ পথ চলেছে—সে দলের নেতাকর্মীরা তিনি গ্রেপ্তার হলে আর যাই হোক সর্বস্ব দিয়ে মাঠে নামবেন, তাকে মুক্ত করার জন্য।
এ আত্মবিশ্বাস থেকেই খালেদা দেশে ফিরে আসেন। তিনি হয়ত ধরে নিয়েছিলেন একমাত্র তার গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়েই সরকার বিরোধী আন্দোলন দাঁড়াবে—বিএনপির নেতৃত্বে জনগণ হয়ত তার মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নামবে। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে যে দল এত রক্ত ঝরালো, তার নিজের অতি প্রিয় সেই দল তার মুক্তির জন্য কিছু লোক দেখানো ছাড়া- এক অর্থে কোন আন্দোলনই করল না।
শুধু তাই নয়, তিনি যে সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না বলেছিলেন, তিনি জেলে যেতে না যেতেই বিএনপির নেতারা দলকে সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচনে নিয়ে যায়। এ সমস্ত কিছুই জীবন সায়াহ্নে এসে খালেদার ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
গত ৩৭ বছর ধরে বিএনপির সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে। তাকে আঁকড়ে ধরেই বিএনপি রাজনীতির নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। সেই তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ।
বেশ অনেকদিন ধরে খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে তিনি লিভার সিরোসিসসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত। খালেদা জিয়াকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার মত প্রযুক্তি বাংলাদেশে না থাকার ফলে তারা তাকে দ্রুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অথবা জার্মানিতে পাঠানোর সুপারিশ করেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবল চাপের মুখে থাকা বিএনপি তাদের দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর ইস্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এটিও আরো অনেক উদ্যোগের মতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। জনগণের বড় অংশকে সম্পৃক্ত করতে পারা তো দূরের কথা, দলটি তার মাঠ পর্যায়ের সব নেতাকর্মীদেরই এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাস্তায় নামাতে পারেনি।
বিএনপি নেতাদের ব্যর্থতার কারণ কী?
অবশেষে বেরিয়ে এলো থলের বিড়াল, ফাঁস হলো খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন নিয়ে বিএনপি নেতাদের রহস্যময় অনীহার নেপথ্য কথা। পিঠ বাঁচানোর পাশাপাশি মামলা থেকে রেহাই পেতে এবং ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট রাখতেই মির্জা ফখরুলরা ইচ্ছাকৃতভাবে আইনি মারপ্যাঁচের এমন প্রহসনের নাটক করেছেন বলে জানা গেছে। যুক্তরাজ্য বিএনপির এক শীর্ষ নেতার বরাতে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি লন্ডনে চলে যাওয়া বিএনপিত্যাগী এক নেতার এমন মন্তব্যে যুক্তরাজ্য বিএনপিতে চলছে তোলপাড়। খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের লুকোচুরি ও পিঠ বাঁচানোর অপরাজনীতির বিষয়টি জেনে হতবাক ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন খোদ তারেক রহমানও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাজ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নাসির আহমেদ শাহীন গত ২০ জানুয়ারি গোপনে এম মোরশেদ খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপি ত্যাগ এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন নিয়ে নেতাদের জুয়া খেলার বিষয়ে জানতে পেরেছেন।
তিনি মোরশেদ খানের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার জেল ও মুক্তির আন্দোলনকে স্তিমিত রাখতে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আঁতাত করেছেন মির্জা ফখরুলরা।
একইসঙ্গে মামলা ও জেল-জরিমানা থেকে বাঁচতে করেছেন নিদারুণ গড়িমসিও। এ নিয়ে তৃণমূল থেকে আন্দোলন গড়ে তোলার শত অনুরোধ এলেও কৌশলে তাদের আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত রেখেছেন মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, জমির উদ্দিন সরকার ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতো কৌশলী নেতারা।
পাশাপাশি তারেক রহমানকেও ভুলভাল বুঝিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধা দিয়েছেন এই নেতারা। এর ফলে খালেদা জিয়াকে ২৫ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে, এমনকি এখনো তাকে মুক্ত করা যায়নি।
এদিকে এম মোরশেদ খানের এমন বিতর্কিত তথ্য তারেক রহমানের কানে পৌঁছালে তিনি বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে যুক্তরাজ্য বিএনপির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
একইসঙ্গে নিজেরা বাঁচতে খালেদা জিয়াকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করার যে হীনমন্যতা মির্জা ফখরুলরা দেখিয়েছেন, তা নিয়েও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন তিনি।
কিন্তু দলের বিপর্যয়ে মুখ ফুটে এখনই এর প্রতিবাদ করতে না পারলেও সুদিন ফিরলে ঠিকই তাদের ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত নেবেন বলে কঠোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ