প্রতি বছর বসন্ত ও শরৎকালে কানাডা ও লাতিন আমেরিকার মধ্যবর্তী অভিবাসন পথ, শিকাগোর আকাশচুম্বী ভবনগুলোর দেওয়ালে আছড়ে পড়ে মারা যায় হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি।
তবে পাখিদের এই মৃত্যু বৃথা যায় না। ১৯৭০ এর দশক থেকে রাস্তায় পড়ে থাকা পাখিদের মরদেহ সংগ্রহ করে তালিকাভুক্তির কাজ শুরু করে শহরের ফিল্ড মিউজিয়াম। তথ্যের এই অনন্য সংগ্রহটি ব্যবহৃত হয়েছে এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায়; সেখানে উঠে এসেছে আরও কিছু নতুন তথ্য।
গবেষকরা ১৯৭৮ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শিকাগোর আকাশচুম্বী দালানগুলোর গায়ে আছড়ে পড়া অন্তত ৭০ হাজার পাখির তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। সংগৃহীত তথ্যে ৫২টি প্রজাতির পাখির মধ্য থেকে ৪৯টি প্রজাতির পাখির মস্তিষ্কের আয়তনের পরিমাপ ও এদের জীবনকালের তথ্য সংযুক্ত করেছেন তারা।
গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর আমেরিকার পরিযায়ী পাখিরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পরিবর্তিত হচ্ছে নিজেরাও। সঙ্কুচিত হয়ে আসছে তাদের শরীরের আকার।
এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নতুন আরেকটি সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বলা হয়েছে, শরীরের তুলনায় যেসব পাখির মস্তিষ্ক বড় তাদের শরীরের আকার ছোট মস্তিষ্কের পাখিদের মতো অতটা সঙ্কুচিত হয় না।
সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, এই গবেষণা প্রথমবারের মতো মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উপলব্ধির সঙ্গে প্রাণীর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি সম্ভাব্য সংযোগ তৈরি করেছে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি’র ছাত্র ও ইকোলজি লেটার্স জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষণাটির লেখক জাস্টিন বাল্ডউইন এক বিবৃতিতে বলেছেন, “তাপমাত্রা উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের আকার হ্রাস পাচ্ছে। তবে বৃহত্তর-মস্তিষ্কের প্রজাতিগুলো ছোট-মস্তিষ্কের প্রজাতির তুলনায় কম গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে।”
গবেষণা অনুসারে, মস্তিষ্কের আপেক্ষিক আকার প্রায়ই পাখিদের আচরণগত নমনীয়তার একটি নির্দেশক হিসেবে ধরা হয়। তবে ধারণাটি কেবল পাখিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে এটি বিতর্কিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাল্ডউইন।
তিনি বলেন, মস্তিষ্কের আপেক্ষিক আকার বৃদ্ধি শেখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি, দীর্ঘ জীবনকাল ও আরও স্থিতিশীল জনসংখ্যার গতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পাখির মস্তিষ্ক বড় (যেমন- চড়ুই পাখি) তাদের শরীরের আকার হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা ছোট মস্তিষ্কের পাখিদের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
যেমন উড ওয়ারব্লার নামের ইউরোপীয় পরিযায়ী পাখির কথাই বলা যেতে পারে। এদের মস্তিষ্ক ছোট, তাই এরা আকারে অন্যদের তুলনায় বেশি সঙ্কুচিত হয়।
বাল্ডউইন বলেন, এই চমৎকার গবেষণাটির লেখকরা তাদের তথ্য আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। যার মাধ্যমে আমরা আরও বিস্তারিত জানতে ও আবিষ্কার করতে পেরেছি।
গত বছর সেপ্টেম্বরে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সংকটের কারণে প্রাণীরা প্রতিনিয়ত তাদের ‘আকার পরিবর্তন’ করছে।
বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধানে জেনেছেন, উষ্ণ রক্তের প্রাণীরা তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য (ফিজিওলজি) পরিবর্তন করে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের চক্ষু, পা এবং কান প্রসারিত হচ্ছে।
এ ছাড়া দেহ অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পাখিরা তাদের ঠোঁট এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীরা কান ব্যবহার করে সে তাপ বিকিরণ করে বা ছড়িয়ে দেয়। তবে যদি প্রাণীরা তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অতিরিক্ত গরমে তারা মারাও যেতে পারে।
ট্রেন্ডস ইন ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন জার্নালে সমীক্ষা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পাখিদের মধ্যে পার্থক্যগুলো বিশেষ প্রকট। গবেষণার লেখক এবং ডেকিন ইউনিভার্সিটির পক্ষী গবেষক সারা রাইডিং বলেন, আকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে এর অর্থ এই নয় যে, প্রাণীরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে বরং ব্যাপারটি মোটেও স্বাভাবিক নয়।
এর মানে হলো এই যে, তারা বেঁচে থাকার জন্য এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিশ্চিত নই যে এই পরিবর্তনের অন্যান্য পরিবেশগত পরিণতি কী হবে, কিংবা সব প্রজাতিই এভাবে অভিযোজিত হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে কি না।
রাইডিং বলছেন, যেভাবে আমাদের গ্রহটি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তাতে অচিরেই এসব পরিবর্তন আর নগণ্য হিসেবে থাকবে না। এখন যেসব পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা সব মিলিয়ে ১০ শতাংশেরও কম হবে। ফলে চট করে এসব পরিবর্তন চোখে পড়ে না।
কিন্তু এভাবে যদি প্রাণীদের কান বড় হতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা বাস্তবেই হয়তো ডাম্বোকে (ওয়াল্ট ডিজনি প্রোডাকশনের একটি কাল্পনিক/এনিমেটেড চরিত্র) দেখতে পাব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ