মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে নানামুখি সংকট চলমান রয়েছে। দেশটিতে দারিদ্রতার পরিমাণ এতটাই যে, গত ২০ বছরের মধ্যে দেশটিতে এই পর্যায়ের দারিদ্র্য আর দেখা যায়নি। চলমান বিক্ষোভের পরিস্থিতিতে গভীরতর আর্থিক সংকটে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। অসংখ্য মানুষের চাকরি হারানো, খাবারের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি কারণে দেশটির নাগরিকদের খাদ্য জোগাড় করতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
মারাত্মক খাবার সংকটের মধ্যে পড়েছেন মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ রাজ্যের প্রাসু টাউনশিপের বাসিন্দারা। সামরিক জান্তা সরকারের বাহিনী এবং প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর মধ্যে চলা সংঘর্ষে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ক্ষুধায় কাতর ওই এলাকার বাসিন্দারা ভুট্টার সঙ্গে চাল মিশিয়ে রান্না করে খেয়ে টিকে আছেন। খবর দ্য ইরাবতী
জান্তা সরকারের নির্বিচার বিমান হামলা এবং প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে কায়াহ রাজ্যে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। রাজ্যটির রাজধানী লইকাউ এবং ডেমোসোর মতো শহরগুলো জনশুন্য হয়ে পড়েছে।
বাস্তুচ্যুত শিবিরে বসবাসকারী বেসামরিক বাসিন্দারা জানিয়েছেন, চাল সংকটের কারণে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ক্ষুধার্ত রয়েছেন তারা। আর তাদের কাছে সামান্য কয়েক দিনের মতো চাল ও ভুট্টা রয়েছে।
কারেন্নি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের মুখপাত্র কো বানিয়ার বলেন, ‘বাওলেক গ্রাম সংলগ্ন মানুষেরা ক্ষুধার্ত। জান্তা সেনা সদস্যরা গ্রামের কাছের একটি পাহাড় থেকে পানি সংগ্রহ করছে এবং নিয়মিতভ প্রতিরোধ গ্রুপের সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছে। সেনা সদস্যদের কারণে এলাকাটি বিপজ্জনক এবং খাবার সরবরাহ কঠিন। গ্রামবাসী চাল ও ভুট্টার মিশ্রণ খাচ্ছে।’
কো বানিয়ার আরও বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পর থেকে লড়াইয়ের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। মানুষের খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলো কায়াহতে খাবার সহায়তা দিতে চায় কিন্তু শাসক গোষ্ঠী তাদের প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। সংঘাত চলতে থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে।’ তিনি জানান, এক বস্তা চালের দাম ৩০ হাজার কিয়াত থেকে বেড়ে ৬০-৭০ হাজার কিয়াতে পৌঁছেছে।
প্রাসু টাউনশিপের এক কৃষক বলেন, ‘আমরা ধান চাষ করতে পারি না। আমরা তিল এবং ভুট্টা বিক্রি করে চাল কিনি। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা খাবার সংকটে পড়েছি।’
মারাত্মক খাবার সংকটের মধ্যে পড়েছেন মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ রাজ্যের প্রাসু টাউনশিপের বাসিন্দারা। সামরিক জান্তা সরকারের বাহিনী এবং প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর মধ্যে চলা সংঘর্ষে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ক্ষুধায় কাতর ওই এলাকার বাসিন্দারা ভুট্টার সঙ্গে চাল মিশিয়ে রান্না করে খেয়ে টিকে আছেন।
কায়াহ রাজ্যে সংঘাতের কারণে কৃষকেরা তাদের শস্য বিক্রি করতে পারছেন না। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে রেখেছে জান্তা সরকার। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভুট্টা, তিলসহ অন্য শস্যের দাম পড়ে গেছে।
কায়াহ রাজ্যে ধান উৎপাদনের জমি রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর। রাজ্যটিতে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় তাতে সেখানকার বাসিন্দাদের চাহিদার মাত্র অর্ধেক পূরণ হয়।
অর্থনৈতিক সংকট পণ্য মূল্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, মিয়ানমারে এখন প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, অভ্যুত্থানের আগে যা ছিল ১০ লাখ। এখন ৪৮ কেজির এক ব্যাগ চালের দাম ৪৮ হাজার কিয়েট, যা ফেব্রুয়ারি থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। গ্যাসের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। এক লিটারের দাম ১ হাজার ৪৪৫ কিয়েট। এই সংকট ব্যবসা-বাণিজ্যেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে, বিশেষত যারা কাঁচামাল আমদানি করেন।
মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, দেশটির জনগণ ‘এক মারাত্মক সংকটের’ মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, গত ২০ বছরের মধ্যে দেশটিতে এই পর্যায়ের দারিদ্র্য দেখা যায়নি।
জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে অ্যান্ড্রু কিরকুড জানান, গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে সহায়তার প্রয়োজন পড়া মানুষের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটিতে। আর দুই কোটি জনগণ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, যা দেশটির জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
ইয়াঙ্গুন থেকে যুক্ত হয়ে অ্যান্ড্রু কিরকুড বলেন, এই সংকটের কারণ হলো ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাচ্যুত করা এবং করোনা মহামারি।
জাতিসংঘের মিয়ানমার দূত কিরকুড বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর জাতিসংঘের খাবার ও অর্থ সহায়তা ১৪ লাখের বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। মূলত প্রান্তিক এলাকায় এসব সহায়তা দেওয়া হলেও কয়েকটি শহর এবং আধা শহর এলাকাতেও এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
অ্যান্ড্রু কিরকুড বলেন, ‘আমরা জীবন রক্ষা করছি। একটা পার্থক্য গড়ছি। কিন্তু আমরা হতাশাগ্রস্তও যে এই সংখ্যা বাড়ছে না আর আমরা সেই তিন কোটি মানুষের সবার কাছে পৌঁছাতে পারছি না যাদের অবিলম্বে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।’
সহায়তা প্রদানে নানা চ্যালেঞ্জে পড়ার কথাও জানান জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত মানবিক সহায়তা সমন্বয়ক অ্যান্ড্রু কিরকুড। তিনি বলেন, সড়ক অবরোধ, মহামারি নিষেধাজ্ঞা এবং সামগ্রিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে সমস্যায় পড়ছেন তারা। মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে সংশ্লিষ্ট সকলকে সহায়তা করার আহ্বান জানান তিনি।
এর আগে মিয়ানমারের সংকট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে, এমনকি এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে বৃহৎ সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘপ্রধান আন্তোনিও গুতেরেস। এমন ‘বহুমুখী বিপর্যয়’ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানান সংস্থাটির মহাসচিব।
গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, মিয়ানমারে সেনাশাসন প্রতিরোধের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসতে পারে। সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ফেরাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দেশগুলোর সাহায্য জরুরি।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল বহাল অপরিহার্য। এটি আদায়ে প্রতিবেশী দেশগুলো মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের অবিলম্বে মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এছাড়া রাখাইনে থেকে যাওয়া ছয় লাখ এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গাসহ দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য দ্রুততম সময়ে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সু চির সরকারকে হটিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন দেশটির সাধারণ মানুষ। শুরু হয় সংঘাত। এতে প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজারের বেশি মানুষ।
নিজ দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে দমনপীড়নের জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও সেনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরও কমেনি জান্তার দমনপীড়ন। পাল্টা-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন সেনাশাসনের বিরোধীরা। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ