করোনা মহামারি চলাকালে বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়ছে খাবারের দাম। মৌলিক খাদ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীব্যাপী খাদ্য সুরক্ষার ওপর চাপ বেড়েছে। বিশ্বে খাদ্যের দাম ২০২১ সালে গড়ে ২৮ শতাংশ বেড়েছে। লাফিয়ে দাম বাড়ার এই হার গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি বছর এই বাজার স্থিতিশীল হওয়ার আশাও ক্ষীণ বলে মনে করছে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা।
দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুই বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বে তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনা মহামারি। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রভাবে সবকিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যদ্রব্যের বাজারেও কোভিড মহামারির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ২০২০ সালের গোড়ার দিকে যখন বিশ্বের বেশিরভাগ অংশ লকডাউনে চলে গিয়েছিল, তখনই ধারণা করা হচ্ছিলো যে মজুতদারি এবং বিভিন্ন দেশের সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খাবারের দাম বেড়ে যেতে পারে।
লকডাউনের প্রথম দিকে খাদ্যদ্রব্যের দাম মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও কয়েক মাস পরে যখন উন্নত বিশ্বে মহামারির প্রকোপ কমে যায় এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু হয়, তখন উদ্বেগজনকহারে খাবারের দাম বাড়তে শুরু করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি সূচক অনুসারে, ২০২১ সালের মে মাসে খাবারের দাম পূর্ববর্তী ১২ মাসের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১ সালের পর খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির এই হার ছিলো সর্বোচ্চ।
২০২২ সালের শুরুতেও বিভিন্ন দেশ কোভিড ১৯-এর কারণে লকডাউনে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে খাবারের দাম কমার সম্ভাবনা কম। খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ ছিলো ২০১৮ সালে চীনে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাব। সোয়াইন ফ্লুর কারণে চীনে শুকরের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে যায়। ফলে ২০১৯ ও ২০২০ সাল জুড়ে চীন প্রচুর পরিমাণে শুকরের মাংস এবং প্রোটিনের বিকল্প উৎস যেমন মুরগী ও মাছ আমদানি করতে বাধ্য হয়।
সে সময় বিশ্বব্যাপী খাদ্যদ্রব্যের বাজারে এর প্রভাব পড়ে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ চীন সোয়াইন ফ্লুর ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কাটিয়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু সম্প্রতি কিছু আলামত থেকে মনে হচ্ছে চীনে এই রোগটি আবারও ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাবও খাদ্যপণ্যের বাজারে পড়বে এবং ২০২২ সাল জুড়ে কোভিড ১৯-এর পাশাপাশি চীনের সোয়াইন ফ্লুর প্রভাবও খাদ্যপণ্যের বাজারকে অস্থির করে রাখবে।
আরেকটি ব্যাপার হলো, করোনা মহামারির তাণ্ডব পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুনরায় শুরু হয়েছে। ব্যাপক চাহিদার কারণে প্রায়ই যাত্রীবাহী বিমানে তাজা ফল ও সবজির মতো খাদ্যসামগ্রী পরিবহন করা হচ্ছে। ফলে পরিবহন ব্যয় যাচ্ছে বেড়ে। চাল, ডাল, চিনির মতো অপচনশীল খাদ্যদ্রব্য সাধারণত জাহাজেই পরিবহন করা হয়।
কিন্তু সীমিত পরিবহন ব্যবস্থা, তেলের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে জাহাজের পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে গেছে।এগুলোও খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে। এ বছর এই সমস্যাগুলোর সমাধান হতে পারে তবে সেটা হবে খুবই ধীরগতিতে।
কৃষি-উৎপাদন সবচেয়ে বেশি নির্ভর করবে আবহাওয়ার ওপর। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার শস্য উৎপাদনকারী অঞ্চলে খরার কারণে ২০২১ সালের গোড়ার দিকে শস্যের দাম কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। এরপর সারা বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনে করেন গত বছরের আগের বছরের মতো এ বছরও শীতকাল জুড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা কম থাকবে। এর প্রভাবে আবহাওয়া শুস্ক থাকবে এবং খরা দেখা দেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও বন্যা-দাবানল ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগের তুলনায় বেড়েছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও ফসলের উৎপাদন ব্যহত হতে পারে এবং এর প্রভাব পড়তে পারে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে।
তবে এই নেতিবাচক সংবাদগুলো দেখে একেবারে আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই। সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতি স্বত্বেও খাবারের মূল্য সম্ভবত ২০০৭-০৮ সালের তুলনায় চলতি বছর কম থাকবে। সে সময় খাদ্যসংকট বিশ্বব্যাপী দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। বেশির ভাগ দেশই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ও মজুতদারির মতো সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা পরিহার করেছে যা তখনকার সঙ্কট প্রকট করে তুলেছিল। আরেকটা ব্যাপার হলো মানুষ এখন অধিক হারে প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ করে। তাই কাঁচামালের উচ্চ মূল্যের প্রভাব খুচরা বাজারে কম পড়ে।
দরিদ্র দেশগুলোতে মানুষ যেহেতু প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খায়, তাই কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব এই দেশগুলোর বাজারে তীব্র ভাবেই পড়তে পারে। এছাড়া স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, কোভিড-সম্পর্কিত বিধিনিষেধের ফলে মানুষের আয় কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণেও দরিদ্র দেশগুলোতে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
তবে দরিদ্র দেশগুলোতে মানুষ যেহেতু প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খায়, তাই কৃষিপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব এই দেশগুলোর বাজারে তীব্র ভাবেই পড়তে পারে। এছাড়া স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, কোভিড-সম্পর্কিত বিধিনিষেধের ফলে মানুষের আয় কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণেও দরিদ্র দেশগুলোতে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এর একটি প্রতিকার হতে পারে ভ্যাকসিন। যেন কোভিড সম্পর্কিত বিধিনিষেধ শিথিল রাখা যায় এবং ব্যবসা বাণিজ্য চালু রাখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রেও দ্রুত উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এদিকে খাবারের দাম বেড়ে যাওয়া বিভিন্ন দেশে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। এতে দরিদ্র ও আমদানি নির্ভর দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। দক্ষিণ আমেরিকায় খরা এবং মালয়েশিয়ায় বন্যার কারণে তৈলবীজের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় ২০২২ সালের শুরুতেই ফসলের বাজারে অস্থিতিশীল ভবিষ্যতের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই এ বছর খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সতর্ক করেছে এফএও।
এদিকে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ বেঁধে দেয়া সময়সীমা বলে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ঘোচাতে হবে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের অভাব৷ কিন্তু প্রথম কয়েক বছরে উন্নতি করার পর, এখন বাস্তবতা ভিন্ন৷ সাম্প্রতিক ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক জানাচ্ছে যে ‘‘ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই বিপজ্জনকভাবে পথভ্রষ্ট” হয়ে পড়েছে৷
ডয়েচে ভেলে জানাচ্ছে, পণ্যের মুক্ত চলাফেরায় ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটায় করোনা অতিমারি৷ এর ফলে, জিনিসের দাম বাড়তে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে আসে৷ নগর ও গ্রাম দুই অঞ্চলেই দারিদ্র্য চরম হয়, দেখা যায় খাদ্যের সংকট, জানাচ্ছে এফএও৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি গবেষণামতে, মাংস, মাছ, ডিমের মতো পণ্যের দাম ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ৷
পাশাপাশি, আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশে খাদ্য পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংকট আরো গভীর হয়েছে৷ অতিমারির আগের তুলনায়, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে প্রায় ২৬ লাখ শিশু স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷
সহিংসতায় জর্জরিত অঞ্চলগুলিতে ফসল নষ্ট হয়, কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রাণীদের চুরি বা মেরে ফেলা হয় ও স্থানীয় জনগণ ঘরছাড়া হয়ে পড়ে৷
বিশ্বের যে ১০টি দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যা সবচেয়ে প্রকট, সেই দশটির মধ্যে আটটি দেশেই এই সংকটের মূল কারণ সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা, জানাচ্ছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক৷ এর সাথে, যত বেশি উগ্র ও ভয়াবহ হচ্ছে সহিংসতার ধরণ, তত বেশি কঠোর হচ্ছে খাদ্যের অভাব৷
শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যের অভাব থেকেও জন্ম নিতে পারে সহিংসতার পরিবেশ৷ খাদ্য পণ্যের দখল নিয়ে যত বেশি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, যত বেশি করে এই দ্বন্দ্বে এসে জুড়বে ধর্ম, ভাষাভিত্তিক সংঘর্ষ, তত বেশি প্রকট হবে খাদ্য সংকট, এমনটাই মত ২০১৭ সালের বিশ্ব খাদ্য প্রোগ্রামের একটি গবেষণার৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামরিকতন্ত্রী রাষ্ট্র ও যুদ্ধবাজ মানুষের অমানবিক ও সহিংস তাণ্ডবে বিশ্বের বহু দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক মৃত্যু ও রক্তপাতে নিপতিত, যারা খাদ্যের সংস্থান করা তো দূরস্থিত, জীবন বাঁচাতেই মরিয়া। রণাঙ্গনে, শরণার্থী শিবিরে, পথে পথে সংঘাতদগ্ধ এইসব বিপুল ভাসমান মানুষের জীবন কাটে অনাহারে, অর্ধাহারে, খাদ্যহীনতায়।
সুষম বণ্টন আর শান্তি বিরাজমান থাকলে বিপুলা এই পৃথিবীর উর্বর ভূমিতটে উৎপাদিত খাদ্যের দ্বারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ততপক্ষে এক মুঠো ভাত জুটতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শোষণ, লুণ্ঠন, যুদ্ধ, দখল, রক্তপাতের ফলে তা হচ্ছে না। হিংসা, হানাহানি ও লুটপাটের তাণ্ডবতায় শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মানুষের মুখের গ্রাস।
তারা বলেন, খাদ্যের নিরাপত্তার অভাবকে না মিটিয়ে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি অসম্ভব৷ শান্তি ছাড়া বিশ্বজুড়ে ক্ষুধাকে হার মানানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ৷ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার৷ আজ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করি যেখানে প্রতি দিন লাখ লাখ মানুষ এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ