এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০০৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ক্রসফায়ার, শুটআউট, বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ২ হাজার ৮৫০ জন। এই সংখ্যা কমবেশি হতে পারে, কিন্তু এগুলো সংখ্যা নয়, একেকটা মানুষের জীবন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকেননি। উপরন্তু বাংলাদেশের র্যাবের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পুঁজি করে বাংলাদেশে সরকার বিরোধীরা জনমত গড়ে তুলতে চাইছে। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে তৎপর হয়েছে সরকার।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, টক শোতে হচ্ছে আলোচনা, ছক কষছে বিরোধীরা। এদিকে, সরকার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য লবিস্ট নিযুক্ত করেছে।
সময় সাপেক্ষ এবং জটিল হবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার
বাংলাদেশের র্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সময় সাপেক্ষ এবং জটিল হবে ধারণা করছেন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেয়া এ বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী তৎপরতা চালাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে অবস্থানরত মার্কিন নীতি বিশ্লেষক প্রশান্ত পরমেশ্বরণ বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা এবং এটি প্রত্যাহারের ব্যাপারটি মার্কিন স্বার্থ এবং ভূরাজনৈতিক জটিল সমীকরণের অংশ হিসেবে দেখছেন।
তিনি বলেন, বিধি-নিষেধ আরোপ সহজে হলেও এটি প্রত্যাহার বেশ কঠিন। বিশেষকরে ট্রেজারি যখন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অর্থ, এটি মোকাবেলার জন্য নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ লাগবে।
এছাড়া আমার সন্দেহ, যেহেতু আরো কিছু দেশের সঙ্গে একসাথে এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তাই এটি অন্যান্য দেশের সাথে একত্রে পর্যালোচনা করতে হবে। আমি মনে করি এটি হলো বড় চ্যালেঞ্জ।
লবিস্ট নিয়োগ কতটা যৌক্তিক?
সূত্র মতে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহ্যারের পদক্ষেপ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রয়োজনে সেখানে লবিস্ট নিয়োগেরও পরামর্শ দেয়ার খবর বেরিয়েছে।
সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক প্রত্যাহার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, নিশ্চয়ই আমেরিকা সরকারকে কনভিন্স করা হয়েছে। কাজেই যে তথ্যের ভিত্তিতে দিয়েছে সেই তথ্য যতটুকু আছে সেটা কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা বা সঠিক কি সঠিক না এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বক্তব্য যাবে।
এছাড়া আমেরিকাতে লবিস্ট নিয়োগের একটা কালচার আছে, সেই লবিস্ট নিয়োগ করে আমেরিকান সরকারকে বুঝাতে হবে। আর ব্যক্তিদের ওপরে যে নিষেধাজ্ঞা সেটি প্রত্যাহার চেয়ে আমেরিকা সরকারের কাছে আপীল করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদলের রাজনীতির অনেক সমর্থক ও শুভাকাঙ্খী রয়েছে। উভয় দলের পক্ষে মার্কিন প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে লবিস্ট নিয়োগের কথাও শোনা যায়। সরকার বিরোধীরা বক্তব্য দিচ্ছেন এরকম আরো নিষেধাজ্ঞা আসবে।
যদিও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আরোপ কিংবা প্রত্যাহার করতে লবিং কতটা কাজ করছে সেটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন যুক্তরাষ্ট্র অবস্থানরত বিশ্লেষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি বলেন, যে আদর্শিক এবং কৌশলগত অবস্থান থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে সেখানে লবিস্ট নিয়োগ করে বাইডেন প্রশাসনকে প্রভাবিত করা কোনো পক্ষের জন্যই সহজ কাজ হবে না।
তার ভাষায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমার যে দীর্ঘ অবজারভেশন সেখানে মনে হয়েছে লবিস্টদের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্র নীতির সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বরং লবিস্টদের দ্বারা যে জিনিসটা হয়েছে যে আপনার যে কনসার্নটা এখানকার রাজনীতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থাটা সম্পর্কে একটা ব্রিফ তাদের কাছে যাচ্ছে। এর বাইরে খুব বড়দাগে কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয় বা হবে বলে আমার কাছে কখনোই মনে হয়নি।
কোন পথে এগোবে বাংলাদেশ?
এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি এবং বাইডেন প্রশাসনে নীতিগত অবস্থানের দিকটি তুলে ধরে প্রশান্ত পরমেশ্বরণ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা এবং সম্পর্ক উন্নয়নই হবে একটা বড় উপায়।
তিনি বলেন, বহুমুখী পন্থা কাজ করবে। প্রথমত যেহেতু সুনির্দিষ্ট আচরণকে তুলে ধরা হয়েছে, তার সংশোধন বা সামধান করতে হবে। একইভাবে বৃহত্তর কৌশলগত তাৎপর্যটি খতিয়ে দেখতে হবে যে কেন এটি করা হলো।
তার মতে, এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকারে বাংলাদেশকে ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে চীনের ব্যাপারে। আঞ্চলিক সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি খাতে সহযোগিতার মত বহু বিষয় বাইডেন প্রশাসন আলোচনার টেবিলে আছে যা নিয়ে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ব্যাপার আছে।
অন্যদিকে ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলছেন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে এখন দক্ষ কূটনীতিই ভরসা। তিনি বলছেন, স্ট্রিকট কোনো রুল নেই যে ঠিক এটা এটা করলে প্রত্যাহার হবে বা এটা হলে প্রত্যাহার হবে না। বিষয়টা অনেকটা সেরকম নয়।
সুতরাং নির্ভর করছে যে বাংলাদেশ কতটা কূটনৈতিক তৎপরতা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চালাতে পারছে এবং বাংলাদেশ তার অবস্থানে থেকে কতটা নেগোশিয়েট করতে পেরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সেই কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ভবিষ্যৎ।
ইফতেখার আহমেদ বলেন, আগামী দিনে নিষেধাজ্ঞা কি বলবৎ থাকে না সেটা পরিধি বৃদ্ধি পাবে না কমবে; সেটা পুরোটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০৩
আপনার মতামত জানানঃ