সীমান্ত হত্যার সংখ্যা শূন্যতে আনা এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত— দুই দেশই সম্মত হয়েছে কয়েক বছর আগে। এরপরও সেটা বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে। আজও নওগাঁর সাপাহার সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শনিবার ভোর ৪টার দিকে উপজেলার হাঁপানিয়া সীমান্তের মেইন পিলারের পাশে ২৩৬ /১ সাব পিলার এলাকায় ঘটনাটি ঘটে । নিহত সালাউদ্দীন ওরফে মকবুল উপজেলার কৃষ্ণসদা গ্রামের আলাউদ্দীন (বুদুর)’র ছেলে বলে জানা গেছে।
এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনরা জানান, শুক্রবার দিবাগত রাতে স্থানীয় কয়েকজন গরু ব্যবসায়ীর সাথে সালাউদ্দীন গরু নেয়ার জন্য ভারত অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। পরে শনিবার ভোররাতে তারা ফিরে আসার পথে ভারত সীমান্তের ২শ’ গজ অভ্যন্তরে পশ্চিমবঙ্গের হবিবপুর থানার পান্নাপুর ৬৯ বিএসএফ’র নম্বর টহল দল পাচারকারীদের উদ্দেশে গুলি ছোড়ে। এসময় সালাউদ্দীন ওরফে মকবুল গুলি বিদ্ধ হয়। এ সময় তার সঙ্গীরা পালাতে সক্ষম হলেও তার ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। বিষয়টি সকালে স্থানীয় লোকজন জানতে পারলে সালাউদ্দীনের মৃতদেহ ভারত ভূ-খন্ডের অভ্যন্তরে পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা।
মৃত সালাউদ্দীন ওরফে মকবুলের মা বলেন, শুক্রবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে তার ছেলে ট্রলিতে করে গমের বস্তা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। যাবার সময় রাতে ফিরবে না বলেও জানায়।
তারা দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে স্থানীয় লোকজন মারফত তিনি ছেলের মৃত্যুর খবর জানতে পান।
এই ঘটনায় সাপাহার থানা পুলিশ ও স্থানীয় গোয়ালা ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যন কামরুজ্জামান সহ বর্তমান চেয়ারম্যান মোখলেসুর রহমান মুকুল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
এ বিষয়ে উপজেলার হাঁপানিয়া বিজিবির ক্যাম্প কমান্ডার আব্দুল আজিজ ভারতের অভ্যন্তরে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ মরদেহ পড়ে থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, এবিষয়ে পান্নাপুর বিএসএফ ক্যাম্পে পতাকা বৈঠকের জন্য বার্তা পাঠানো হয়েছে। তবে বিএসএফ এখন পর্যন্ত কোন সাড়া দেয়নি। এ কারণে মরদেহ কার তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
নওগাঁ ১৬ বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল কবির হোসেন বলেন, নওগাঁর সীমান্তে একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তবে নিহত ব্যক্তি বাংলাদেশি নাকি ভারতীয়, এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। নিহত ব্যক্তি বাংলাদেশি হলে লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে বিএসএফের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ-ভারত যদিও বন্ধুরাষ্ট্র, তবুও এ দুই দেশের সীমান্তে রাষ্ট্রীয় হত্যা হয় গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে এই গুলির ঘটনা একতরফা। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় কোনো নাগরিক গুলিবিদ্ধ না হলেও ভারতের পক্ষ থেকে নিয়ম করেই গুলি চালিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সীমান্তে মোট ৪৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ৷ এর মধ্যে ৪২ জনকে গুলি করে এবং ছয় জনকে হত্যা করা হয় নির্যাতন চালিয়ে৷ অপহরণ করা হয় ২২ বাংলাদেশিকে৷
ওই সময়ে ২৬ জন বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে গুরুতর আহত হন৷ অপহৃতদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি৷
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু, বাস্তবতা তা বলে না। বেশ কয়েক বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে একটি প্রতিবেদনে এ ধরনের বেশ কয়েকটি মামলার উল্লেখ করেছে। যাতে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন যে বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। বিএসএফ আরও দাবি করেছে যে দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের সদস্যরা গুলি চালায়। তবে কোনও অপরাধের সন্দেহে প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হয় না।
বিএসএফের মেরে ফেলার জন্য গুলি চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের জীবনের অধিকার লঙ্ঘন করে। যা ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এইচআরডাব্লিউ, অধিকার ও এএসকের প্রতিবেদন এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, অপরাধী হিসেবে সীমান্তে হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকে অথবা তাদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পিঠে গুলি করা হয়েছিল।
এইচআরডাব্লিউ আরও উল্লেখ করেছে, তদন্ত করা মামলার কোনোটিতেই বিএসএফ প্রমাণ করতে পারেনি যে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া গেছে; যার দ্বারা তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
সুতরাং, বিএসএফের মেরে ফেলার জন্য গুলি চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের জীবনের অধিকার লঙ্ঘন করে। যা ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, ভালো প্রতিবেশী দেশ সীমান্তে চলাচলকারীদের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করে। ভারত সরকারের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে তার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান করছে এবং আইনের শাসন অনুসরণ করছে। বিএসএফ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে জাতিসংঘের সাধারণ নীতিমালা মেনে চলার জন্য প্রকাশ্যে আদেশ দেওয়া উচিত। বিএসএফের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত তার সদস্যদের বিচার করতে পারেনি। ভারত সরকার বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে নির্যাতনের মামলাগুলো তদন্তের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল দফায় দফায় বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, ২০১৮ সালে যেখানে সীমান্তে হত্যার সংখ্যা ছিল ১১, সেখানে ২ বছরের ব্যবধানে তা চারগুণ ছাড়িয়ে গেছে। ভারত সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্ত হত্যার পেছনেও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সন্দেহ রয়েছে। ভারত ছোট দেশকে সব সময় ছোট করেই রাখতে চায়। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমে। তাই ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৫
আপনার মতামত জানানঃ