আইস বা ক্রিস্টাল মেথ ইয়াবার চেয়েও ভয়ংকর মাদক। কারণ, ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান মেথঅ্যাম্ফিটামিন হলেও ইয়াবায় মেথঅ্যাম্ফিটামিন থাকে মাত্র ১৫ শতাংশ। আর আইস বা ক্রিস্টাল মেথের ৯৬ শতাংশই এ মেথঅ্যাম্ফিটামিন। এটি দেখতে স্বচ্ছ কাচের (ক্রিস্টাল) মতো।
এ মাদক সেবনে নিদ্রাহীনতা, স্মৃতিবিভ্রম, মস্তিষ্কবিকৃতিসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে এ মাদক সেবনে ওজন হারানো, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা এবং বিষণ্নতা ও স্ট্রোকের মতো বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
এদিকে, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছেন।
যেকারণে মাদকের বড় ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে মাদক আসার পথ (রুট) নিয়ে গবেষণা করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। সেখানে তিনটি অঞ্চলের মধ্যে আছে মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা মিলে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল। এটি বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সীমানা রয়েছে।
মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানের পথ হিসেবে ইরান, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানকে একত্রে বলা হয় গোল্ডেন ক্রিসেন্ট। এই অঞ্চল বাংলাদেশের পশ্চিমে।
আর গোল্ডেন ওয়েজ হচ্ছে ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, নেপাল ও ভুটানের কিছু অংশ। এই অংশ বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত।
এ তিন অঞ্চলের কেন্দ্রে থাকা বাংলাদেশের ওপর চার দশকের বেশি সময় ধরে মাদক কারবারিরা চোখ রাখছেন। শুরুর দিকে চোরাচালানির তালিকায় হেরোইন ও ফেনসিডিলের আধিক্য থাকলেও পরবর্তী সময়ে অন্য মাদকও যুক্ত হতে থাকে।
এর মধ্যে গত এক দশকে দেশে ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। আর ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান মেথঅ্যাম্ফিটামিন আসছে বছর দুই ধরে।
মাদক চোরাচালানে বহুমাত্রিকতা এসেছে। চোরাচালানকারীরা এখন “ডার্কওয়েব” ব্যবহার করছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতে কোনো ধরনের তথ্য পাচ্ছে না। লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে বিটকয়েন। এ কারণে মাদক চক্রকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মাদক কারবারিরা যে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করছেন, সে অনুযায়ী আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশে আইসের বিস্তার
বাংলাদেশে মেথঅ্যাম্ফিটামিন আইস বা ক্রিস্টাল মেথ নামে পরিচিত। ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ ও ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ অঞ্চলে এ আইসের উৎপাদন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। মূলত ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত উৎপাদন বৃদ্ধির এ প্রবণতা ব্যাপক। বিশ্বে আইসের যে বাজার তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে এ দুটি অঞ্চল অন্যতম।
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত মিয়ানমার যে ছয়টি দেশের বাজার সামনে রেখে আইস উৎপাদন করছে, এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে বলে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির সর্বশেষ বৈশ্বিক মাদক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
দুই বছর ধরে দেশে আইসের চালান আসছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) বলছে, গত বছর অভিযানে আইসের ২২টি চালান জব্দ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশে এ মাদকের বাজার ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। ইয়াবার মতোই এটি সারা দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ যেহেতু মাদক চোরাচালানের তিন প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে, তাই আন্তর্জাতিক মাদক চক্র এ দেশে সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা ও নাইজেরিয়ান চক্র বেশি সক্রিয়। তারা বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাদক পাচার করছে।
সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ইয়াবার তিনটি কারখানার তথ্য পায় ডিএনসি। গত অক্টোবরে আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে ভারতকে এসব কারখানার তালিকাও দিয়েছে সংস্থাটি। ওই বৈঠকে কর্মকর্তারা ভারতকে জানিয়েছেন, কয়েকটি রাজ্য হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা ও আইস আসছে।
এ কাজে ভারতীয় সমুদ্রপথকেও ব্যবহার করছেন মাদক পাচারকারীরা। এ বৈঠকে ভারত থেকে নানা নামে ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা ও ব্যুপ্রিনরফিন ইনজেকশনের মতো মাদক আসছে বলেও তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ।
আশির দশকের শুরু থেকেই ভারতীয় সীমান্ত এলাকার কারখানায় ফেনসিডিল উৎপাদন করে বাংলাদেশে পাঠানো শুরু করেন মাদক কারবারিরা। এ কারণে তখন থেকেই দেশে ফেনসিডিল সহজলভ্য হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি এখনো তেমন আছে। ডিএনসির আশঙ্কা, এখন ইয়াবা যদি ভারতে তৈরি হয়, সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য চরম উদ্বেগের।
এশিয়ায় আইসের বিস্তার
আইস আগে উত্তর আমেরিকার দেশে উৎপাদিত হতো। ২০১৫ সাল পর্যন্ত উত্তর আমেরিকা ছিল আইসের মূল উৎপাদনকারী অঞ্চল। কিন্তু সেই উত্তর আমেরিকার দেশ ছাড়িয়ে তা এখন এশিয়াতেও উৎপাদিত হচ্ছে।
২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আইস ল্যাব স্থাপনের প্রবণতা বেড়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে ইরান, চীন, আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে আইসের উৎপাদন বাড়ছে। পাশাপাশি এশিয়ায় আইসের বড় বাজারও তৈরি হয়েছে।
বিশ্বে যেসব আইসের ল্যাব পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তর আমেরিকার তিনটি দেশে। ইউএনওডিসির প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে খোঁজ পাওয়া ল্যাবের মধ্যে ৫৬ শতাংশই (৮৯০টি) উত্তর আমেরিকার দেশ যুক্তরাষ্ট্রের। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোপন ল্যাবের খোঁজ পাওয়া যায়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইরানের গোপন ল্যাবে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আইসের ১০ শতাংশ আফগানিস্তানে পাচার করা হতো।
এখন আফগানিস্তানেও তা উৎপাদিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের মে মাসে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানে ৬৮টি আইস ল্যাব ধ্বংস করা হয়।
গত বছরের অক্টোবরে লাওস পুলিশ একটি ট্রাক আটক করে ৫ কোটি ৫০ লাখ ইয়াবা বড়ি ও ১ দশমিক ৫ টন আইস জব্দ করেছে বলে ইকোনমিস্ট–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এর এক সপ্তাহ আগে দেশটির পুলিশ একই এলাকায় দুটি অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ৬০ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দ করে। লাওসের ওই সীমান্ত অঞ্চলটি গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল নামেও পরিচিত। মিয়ানমারের শান প্রদেশ থেকেই লাওসে এসব চালান পাচার করা হয়।
মিয়ানমারই সবচেয়ে বড় ভিলেন
কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে নানা কৌশলে চোরাকারবারিরা ইয়াবা ও আইস নিয়ে আসছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ, লাওস, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের বাজার লক্ষ্য করে আইস তৈরি করছে মিয়ানমার। শুধু এসব দেশ নয়, ইউএনওডিসি আরও বলছে, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াতেও আইসের বাজার তৈরির চেষ্টা করছে মিয়ানমার।
গত বছর দেশে ৩০ কেজির বেশি আইস জব্দ করা হয়। এগুলোর উৎস মিয়ানমার। ইয়াবার রুট ধরেই দেশে আইসের চালান আসছে।বমূলত মিয়ানমার থেকে স্থল ও সমুদ্রপথে এ দেশে মাদক আসে। এত দিন এ পথেই ইয়াবা আসত। ইয়াবার বিস্তার সামাল দিতেই সংশ্লিষ্টদের হিমশিম অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে ইয়াবার চেয়ে ভয়ংকর মাদক আইস আসছে, যা নতুন উদ্বেগের কারণ।
এখনই তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আরও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ডিএনসির কর্মকর্তারা। তাঁরা মিয়ানমার থেকে মাদক আসার ১৫টি পথও চিহ্নিত করেছেন।
মাদকসংক্রান্ত বিষয়ে ভারত, মিয়ানমার ও ইরান ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ইয়াবা ও আইস আসার বিষয়টি জানিয়েছে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তবে বাস্তবে মিয়ানমার মাদক নিয়ন্ত্রণে কতটা আন্তরিক, সেটা ভাববার বিষয়।
শরীরে আইসের প্রতিক্রিয়া
আইস ইয়াবার মতোই সহজে বহনযোগ্য, তবে ইয়াবার চেয়ে বেশিগুণ ক্ষতিকর শরীরের জন্য।
ক্রিস্টাল মেথ বা আইস সেবন করলে কারও স্ট্রোক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। মানসিক অবসাদ বা বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। আরও অন্যান্য ঝুঁকি তো আছেই।
তবে আইস সেবন করে পরে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন ব্যক্তির খবর এখনো পাওয়া যায়নি।
ফলে শুধুমাত্র আইস সেবনে বাংলাদেশে কারও শরীরে ঠিক কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে তা এখনো পরিষ্কার না।
তবে যেহেতু ইয়াবার মূল উপাদান দিয়েই পূর্ণাঙ্গ আইস তৈরি হয়, সে কারণে ইয়াবায় যেসব লক্ষণ বা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সেগুলোই অনেক বেশি আকারে দেখা দেয় আইস সেবনের কারণে।
তারা বলেন, মূলত মানসিক ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রভাব ফেলে। কেউ আসক্ত হলে এটি ছাড়া তিনি আর ঘুমাতে পারেন না। আরও জানা গেছে, আইসে আসক্ত হওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ব্যক্তির কেন্দ্রীয় নার্ভ সিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
এর জালে একবার জড়ালে একমাত্র মৃত্যুই হতে পারে মুক্তির উপায়। এক গ্রাম আইসের বাজারমূল্য ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। স্বভাবতই এর ব্যবহার বেশি ধনাঢ্য শ্রেণির মধ্যে। এখন পর্যন্ত আইসসংশ্লিষ্টতায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ