মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলিট ফোর্স র্যাব এবং বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তা পুনর্বিবেচনা করতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে চিঠি দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
২০২২ সালের নববর্ষ উপলক্ষে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দেন ড. আব্দুল মোমেন। চিঠিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শক্তিশালী করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
চিঠিতে সন্ত্রাস, জঙ্গী, মাদক বিরোধী কর্মকাণ্ডে র্যাবের ভূমিকাও তুলে ধরেন তিনি। প্রসঙ্গত, চলতি বছর ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বাংলাদেশ সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে এটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বড় ধরনের কূটনৈতিক চাপ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক তথা আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মুস্তফা সরওয়ার, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও আনোয়ার লতিফ খান এবং বাহিনীটির সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ।
নিষেধাজ্ঞার পরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এমন নিষেধাজ্ঞা খুবই দুঃখজনক। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি নিজেও বিস্মিত।
সামরিক অনুদান ব্যয়ের তথ্য চায় যুক্তরাষ্ট্র
র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য দেওয়া অনুদান কোথায় কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা জানতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
মানবাধিকার সুরক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য এই অনুদান দেয় দেশটি। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও অনুদানের খরচের খতিয়ান চাওয়ার মধ্যে যোগসূত্র দেখছেন অনেকে।
সূত্র মতে, ১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র এক চিঠিতে জানায়, লিহেই আইনের নতুন সংশোধনী অনুযায়ী মার্কিন অনুদান অব্যাহত রাখতে চাইলে চুক্তি সই করতে হবে।
এ ছাড়া মানবাধিকার সুরক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য দেওয়া অনুদান কোথায়, কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা-ও জানাতে হবে।
মার্কিন অনুদান পেতে বাংলাদেশ চুক্তি করবে কি না, সে বিষয়ে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছিল। যদিও ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর সামরিক অনুদান হিসেবে বাংলাদেশকে কোটি কোটি টাকা দিয়ে থাকে। কিন্তু এই অর্থ কোন বাহিনী পায় এবং কীভাবে ব্যয় হয়, সে সম্পর্কে তাদেরকে কোনও তথ্য দেওয়া হয় না।
এখন যুক্তরাষ্ট্র জানতে চাচ্ছে তাদের দেওয়া অনুদানের অর্থ কোন বাহিনী পাচ্ছে এবং তারা কীভাবে ব্যয় করছে। এ বিষয়ে একটি চুক্তি সইও করতে চায় মার্কিন সরকার। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে ওই দেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি জোরদার করা একটি স্বাভাবিক ঘটনা।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার অধীনে সামগ্রিক সহযোগিতা রয়েছে এবং এটি তার একটি অংশ। আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামরিকসহ অন্যান্য সহযোগিতা ছিল, আছে এবং থাকবে।’
হঠাৎ কেন এই নিষেধাজ্ঞা?
নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর দমন, নিপীড়ন ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়।
সেখানে র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক মহাপরিচালক (বর্তমানে আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মুস্তাফা সারওয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খানের নাম রয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় র্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর সে দেশে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পৃক্ততার জন্য তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ৬৭টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে র্যাবের সঙ্গে ২৫টি, পুলিশের ২৫টি, নৌ-পুলিশ একটি এবং বিজিবির ক্রসফায়ারে ১৬ জন নিহত হয়েছেন।
১ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রসফায়ারে ছয়জন মারা গেছেন। ৬ ডিসেম্বরের পর দেশে ক্রসফায়ারে কেউ মারা যায়নি। র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাবের সঙ্গে ১ হাজার ২৩টি বন্দুকযুদ্ধে ১ হাজার ৩১০ জন নিহত হয়েছেন। ক্রসফায়ারের ৯৮১টি ঘটনা তদন্ত করে ২৬ জন র্যাব সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
জেনারেল আজিজের চ্যালেঞ্জ
সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সদ্যবিদায়ী জেনারেল আজিজ আহমেদ। ওই প্রতিবেদনে তার এবং তার ভাইদের বিষয়ে বিভিন্ন বিতর্কিত তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। গতকাল শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে ‘খালেদ মহিউদ্দিন জানতে চায়’ শীর্ষক ইউটিউব টকশোতে সেসব বিতর্কিত প্রসঙ্গে মুখ খোলেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। এক ঘণ্টার ওই আলোচনায় কথা বলেছেন তাকে নিয়ে উঠে আসা নানা অভিযোগের বিষয়ে৷
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রচারিত তথ্যচিত্রের কারণে বিব্রত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি বলেছেন, আগামী ২৫ জুন সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে তার অবসর শুরু হলে এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেবেন তিনি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিলের খবরটি নাকচ করে দিয়ে সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেছেন তিনি নিজেও এ খবরটি গণমাধ্যমে শুনেছেন। তার জানামতে, তার বৈধ ভিসা আছে।
সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ দাবি করেছেন, ভাইদের পরিচয়পত্র ও অন্যান্য কাগজে তথ্য পরিবর্তনে কোনো প্রভাব খাটাননি তিনি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করছি, কেউ যদি কোনো একটা ‘এভিডেন্স’ দিতে পারে যে আমি বিজিবিতে থাকাকালে, আমি সেনাপ্রধান থাকাকালে আমার কোনো ভাই বা আত্মীয়কে বিজিবি বা সেনাবাহিনীর কোনো ‘আর্মস, ইকুইপমেন্ট, অ্যামুনিশান প্রকিউরমেন্ট, কন্ট্রাক্ট’ দিয়েছি—এটা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে ‘আই উইল অ্যাকসেপ্ট এনিথিং। আই অ্যাম রেডি। আই অ্যাম গিভিং এ চ্যালেঞ্জ’।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ