তালিবানের দখলে যাবার পর থেকে আফগানিস্তানকে যে অবক্ষয়গুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো গণমাধ্যম। আফগানিস্তানের গণমাধ্যম বিষয়ে তালিবান নিশ্চয়তা দিলেও অনেক সাংবাদিক শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। প্রতিদিন যে হাজার হাজার মানুষ দেশটি ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যে সাংবাদিকেরাও রয়েছেন। অনেকেই বলছেন, তাদের জীবন এখন হুমকিতে। এক দিকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে দোলাচল, মহিলা সাংবাদিকদের উপরে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা এবং নামী সাংবাদিকদের দেশ ছাড়ার হিড়িক, অন্য দিকে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত দেশের সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিয়ো স্টেশন।
এর আগে তালিবান বাহিনীর শাসনের সময় দেশটিতে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধই ছিল বলা চলে। এরপর মার্কিন অভিযানে তালিবানের পতন হওয়ার পর গণমাধ্যম খাতে অগ্রগতি শুরু হয়। এখন আবার ফিরে এসেছে তালিবান শাসন। তাই ভীতিমুক্ত হতে পারছেন না দেশটির সাংবাদিকেরা।
একটি নতুন জরিপে দেখা গেছে যে আগস্টের মাঝামাঝি ইসলামপন্থী তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ দখল করার পর থেকে আফগানিস্তানের অন্তত ৪০ শতাংশ মিডিয়া আউটলেট অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী সাংবাদিক তাদের চাকরি হারিয়েছেন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) তার স্থানীয় অংশীদার, আফগান ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (এআইজেএ) এর সাথে সমীক্ষাটি পরিচালনা করেছে এবং আফগানিস্তানের এক সময়ের বিকাশমান এবং প্রাণবন্ত জাতীয় মিডিয়া সম্পর্কে সম্প্রতি এই ফলাফল প্রকাশ করেছে।
সমীক্ষাটিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয় যে তালিবান দখলের পর থেকে রাজধানী কাবুল এবং দেশের বাকি অংশে সাংবাদিকদের জন্য পরিবেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সমীক্ষা অনুসারে, ‘গ্রীষ্মের শুরুতে আফগানিস্তানে ৫৪৩টি সংবাদ প্রকাশক এবং প্রচারকদের মধ্যে মাত্র ৩১২টি নভেম্বরের শেষেও কাজ করছিল’।
১৫ই আগস্ট তালিবান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে ৬৪০০ এরও বেশি সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মচারী তাদের চাকরি হারিয়েছে।
সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, আনুপাতিকভাবে, নারীদের উপর ‘এরঅনেক বেশী প্রভাব পড়েছে। তালিবান দখলের পর থেকে পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরও বেশি (৮৪ শতাংশ) তাদের চাকরি হারিয়েছেন, যেখানে প্রতি দুইজন পুরুষের মধ্যে একজন (৫২ শতাংশ)।
আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ১৫টিতে কোনো কর্মজীবী নারী সাংবাদিক নেই। উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ জোজজানে আগে ১৯টি মিডিয়া আউটলেট ছিল, সেখানে ১১২ জন মহিলা কর্মী ছিলেন, এখন ১২টি মিডিয়া আউটলেটের মধ্যে একজন নারীকেও নিয়োগ দেয়া হয় না৷
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান শাসনে গণমাধ্যম বলতে কিছু ছিল না। বাহিনীটি টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যমকে ইসলামি মতাদর্শের বিরোধী বলে গণ্য করত। এমনকি সে সময় কিছু কিছু বৈদ্যুতিক পণ্যও অনৈসলামিক হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
কেউ টেলিভিশন দেখলে তাকে শাস্তি দেওয়া হতো এবং টিভিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়া হতো। ভিডিও প্লেয়ারের মালিককে গণপিটুনি দেওয়া হতো।
ক্যাসেট ধ্বংস করে এর ফিতা কাবুলের কিছু কিছু এলাকার গাছে ঝুলতে দেখা গেছে। তখন শুধু একটিই রেডিও স্টেশন ছিল। নাম ভয়েস অব শরিয়া। এটি শুধু প্রপাগান্ডা ও ইসলামিক অনুষ্ঠান প্রচার করত।
২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তালিবান উৎখাত হলে দেশটির গণমাধ্যম খাতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। সে সময় অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও নেটওয়ার্ক আসে। শুধু যে সংবাদের চ্যানেল তা নয়, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রতিভা খোঁজে বের করার অনুষ্ঠান ও মিউজিক ভিডিও তৈরি হয় প্রচুর।
ন্যাশনাল প্রেস ফেডারেশনের কথা উল্লেখ করে সেপ্টেম্বর মাসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানায়, আফগানিস্তানে এখন ৫০টি বেশি টেলিভিশন চ্যানেল, ১৬৫টি রেডিও স্টেশন ও কয়েক ডজন প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
আনুপাতিকভাবে, নারীদের উপর ‘এরঅনেক বেশী প্রভাব পড়েছে। তালিবান দখলের পর থেকে পাঁচজনের মধ্যে চারজনেরও বেশি (৮৪ শতাংশ) তাদের চাকরি হারিয়েছেন, যেখানে প্রতি দুইজন পুরুষের মধ্যে একজন (৫২ শতাংশ)।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল গণমাধ্যমে মেয়েদের কাজ করার সুযোগ দান। যেখানে তালিবানের শাসনকালে নারীদের পরিবারের বাইরে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে তালিবান পরবর্তী সময়ে শত শত নারী সাংবাদিকতা, প্রডিউসার, আয়োজক ও পারফর্মার হিসেবে পর্দার সামনে ও পেছনে কাজ করে গেছেন। এমনকি ডজন ডজন সাংবাদিক বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন।
তবে এবারে মসনদ দখলের পরে অবশ্য নিজেদের অন্য রূপ প্রতিষ্ঠা করতেই মরিয়া হিবাতুল্লা আখুন্দজ়াদারা। ইতিমধ্যেই তালিবান নেতৃত্ব জানিয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই কাজ করতে পারবে সংবাদমাধ্যম। তাদের উপরে কোনও বলপ্রয়োগ করা হবে না। এমনকি ভাবমূর্তি বদলাতে বেহেশতা আরঘান্ড নামে এক মহিলা সাংবাদিককে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন এক তালিবান নেতা। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ মানুষই। টোলো গ্রুপের সিইও সাদ মহসেনির কথায়, ‘আমরা প্রত্যেকেই বিনিদ্র রজনী যাপন করছি’।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানিয়েছে, শতাধিক বেসরকারি চ্যানেল আপাতত পরিষেবা বন্ধ রেখেছে। সংবাদ সংস্থা দ্য পাজওক জানিয়েছে, অধিকাংশ চ্যানেল বন্ধের কারণ আর্থিক সঙ্কট। এ ছাড়া বহু মহিলাকে সংবাদমাধ্যম ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানাচ্ছে, ২০২০ সালে যেখানে কাবুলে অন্তত ৭০০ মহিলা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তালিবানের প্রত্যাবর্তনের পরে সেই সংখ্যা দাড়িয়েছে ৭৬। তালিবান সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার বার্তা দিলেও হেনস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন সাংবাদিকেরা। কাবুল দখলের পরে বহু সাংবাদিকের বাড়িতে হানা দিয়েছে তালিবান যোদ্ধারা। জার্মান সংবাদমাধ্যমের এক সাংবাদিকের পরিজনকে হত্যাও করা হয়েছে। এমনকি লাইভ টেলিভিশন শোয়ে সংবাদ পাঠককে ঘিরে রয়েছে বন্দুকধারীরা, সেই দৃশ্যও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার্থে তালিবান নেতৃত্ব কতটা আন্তরিক। এমনই পরিস্থিতিতে দলে দলে দেশ ছেড়েছেন আফগান সাংবাদিকরা।
এখনো ভীতি কাটছে না আফগানিস্তানের সাংবাদিকদের। দেশটিতে গণমাধ্যম খাতে বেশ অগ্রগতি হলেও বিশ্বে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান একটি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের তথ্যমতে, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে কমপক্ষে ৫৩ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে গণমাধ্যমকর্মীরা ছিলেন এই তালিবান বাহিনীর টার্গেট; যা ছিল স্বাধীন গণমাধ্যমের সূচকে আফগানিস্তানের নিচের দিকে থাকার বড় কারণ।
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আরটিএর নারী সাংবাদিক শবনম দাওরান সম্প্রতি জানান, তাকে কাজ ছেড়ে ঘরে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। কারণ, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের জীবন এখন হুমকিতে।’
আফগানিস্তানের অনেক সাংবাদিক এখন আত্মগোপনে আছেন। অনেকে দেশ ছাড়তে উদ্ধারকারী ফ্লাইট পাওয়ার চেষ্টা করছেন। যারা বিদেশি গণমাধ্যমের জন্য কাজ করতেন, তাদের বেশির ভাগই দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু যারা বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন না, তাদের জন্য দেশ ছেড়ে যাওয়া বেশ ঝক্কির বিষয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ