অ্যান্টার্কটিকার সবচেয়ে বড় হিমবাহগুলোর একটিতে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিচ্ছেন।
থোয়েইটস একটি অতিকায় হিমবাহ। এটির আকার কমবেশি ব্রিটেন অথবা ফ্লোরিডার সমান। গত ৩০ বছর ধরে এটির গলে যাওয়ার গতি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা এই হিমবাহটি পর্যবেক্ষণ করছেন। কারণ এটি খুব দ্রুত গতিতে গলে যাচ্ছে। সূত্র মতে, বর্তমানে বিশালাকার এই হিমবাহ থেকে প্রতিবছরে পাঁচ হাজার টন বরফ মহাসাগরে মিশে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, থোয়েইটস হিমবাহের সামনের যে অংশটি পানিতে ভাসতে দেখা যাচ্ছে, আপাতত সেটি স্থির থাকলেও যেকোনো সময় এটি ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যেতে পারে।
বিশ্বের সমুদ্র সীমায় এর প্রভাব এখনো সামান্য। কিন্তু এই হিমবাহের ওপরের দিকে যত বরফ রয়েছে, তার সব যদি গলে যায়, তাহলে সমুদ্র সীমা ৬৫ সেন্টিমিটার বা ২ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এরকম ভয়াবহ বিপর্যয় শত বছরে একবার আসতে পারে।
কিন্তু গবেষক দল দেখতে পেয়েছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এই হিমবাহে জমে থাকা বরফ গলার হার অনেক বেড়েছে। সম্ভবত আগামী এক দশকের কম সময়ের মধ্যেই এই হিমবাহের সামনের অংশে নাটকীয় একটি পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
এ পর্যন্ত প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত সব গবেষণায় সেই ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে। এমনটাই জানিয়েছেন হিমবাহ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক টেড স্ক্যামবোস। ইন্টারন্যাশনাল থোয়েইটস গ্লেসিয়ার কোলাবরেশন প্রকল্পে স্ক্যামবোস যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কেন এটি ঘটছে, সেটিও শনাক্ত করতে পেরেছেন গবেষকরা। এর মূল কারণ হলো সমুদ্রের উষ্ণ পানি এর নিচে প্রবেশ করছে এবং পানিতে হিমবাহটির সামনের অংশকে গলিয়ে দিচ্ছে।
উষ্ণ পানি এটির জমে থাকা বরফকে সংকুচিত আর দুর্বল করে তুলছে। যার ফলে হিমবাহটির গতি বাড়ছে এবং যেখানে হিমবাহ ভেসে থাকে, সেই এলাকা থেকে সরে যাচ্ছে।
অরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির ড. এরিন পেটিট বলেন, এটাকে আমি একটা গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের সঙ্গে তুলনা করতে পারি, যেখানে কয়েকটি ফাটল দেখা দিয়েছে এবং আস্তে আস্তে সেটা বাড়ছে। হঠাৎ করে গাড়ি একটা ধাক্কা লেগে পুরো কাঁচটা ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়তে পারে।
হিমবাহের আকার হিসেবে বিবেচনা করলে প্রভাবিত এলাকা তেমন বড় নয়। কিন্তু এটি নতুন এলাকার দিকে যাচ্ছে, যার মানে হল হিমবাহ থেকে আরও বরফ গলে যাবে। সেটির ফলে গুরুতর প্রভাব পড়বে।
বর্তমানে হিমবাহের ৪০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের পূর্বের এলাকাটি প্রতি বছর ৬০০ মিটার করে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর উত্তর মেরুতে গ্রীষ্মের সময় বিজ্ঞানীরা হিমবাহগুলোর গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করেন। এজন্য তারা হিমবাহতে অবস্থান করে এবং জাহাজ ও স্যাটেলাইট থেকে নজরদারি করে থাকেন।
সামনের বছর একটি স্বয়ংক্রিয় ডুবোজাহাজ গিয়ে বিজ্ঞানীরা এই হিমবাহের নীচে গিয়ে পানির তাপমাত্রা, বর্তমান গতি ইত্যাদি নিয়ে আরও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করবেন।
বিশাল ফাটল শনাক্ত
প্রথম ২০১৯ সালে একটি ফাটল লক্ষ্য করে বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা নাসার ‘আইসব্রিজ’ উপগ্রহে বসানো রাডারের পাঠানো ছবিতেই অ্যান্টার্কটিকার হিমবাহে এতো গভীরে ফাটল ধরা পড়ে। একই ছবি পাঠায় কক্ষপথে থাকা ইতালি ও জার্মানির উপগ্রহের রাডারও। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ।
শিরোনাম- ‘হেটরোজিনাস রিট্রিট অ্যান্ড আইস মেল্ট অফ থোয়েইটস গ্লেসিয়ার, ওয়েস্ট অ্যান্টার্কটিকা’। দুই মূল গবেষক নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী পিয়েত্রো মিলিল্লো ও আরভিনের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এরিক রিগনট।
সে সময় গবেষক এরিক রিগনট জানান, ফাটলটির গভীরতা এক হাজার ফুটের কিছু বেশি বা ৩০০ মিটারের মতো। শুধু তাই নয়, হিমবাহ না গললে ভূগর্ভের (বেডরক) গায়ে হিমবাহটির নিচের দিকটার লেগে থাকার কথা। কিন্তু উষ্ণায়নের জন্য অ্যান্টার্কটিকার জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় আমরা ভেবেছিলাম, ভূগর্ভের উপরের দিকটা আর হিমবাহটির নিচের দিকটার মধ্যে একটু ফাঁক থাকবে।
আমরা অবাক হয়ে গেছি, ‘আইসব্রিজ’-এর রেডারে ধরা পড়া ছবি দেখে। ভাবতে পারিনি, ফাটলটা এতটা বড় আর এত গভীর হবে। আমরা রীতিমত উদ্বিগ্ন, কারণ ‘আইসব্রিজ’-এর রেডার জানিয়েছে, খুব দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে ওই দৈত্যাকার হিমবাহ- থোয়েইটস। গত তিন বছরে যার ১৪০০ কোটি টন বরফ পুরোপুরি গলে গেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ