বাংলাদেশে যেকোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়, কিন্তু বিচার হয় না৷ যেমন বাবা-মা হত্যার বিচার পাওয়ার আশা ১৮ বছরেও ফুরোয়নি বিমল শীলের। শুধু বাবা-মাই নয়, পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল তার পরিবারের ১১ জনকে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল বিমল শীলের বাবা-মাসহ পরিবারের ১১ জনকে৷ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ক্ষেত্রে ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি’ যে অব্যাহত রয়েছে, এই মামলাটি তারই নজির বহন করছে।
যা ঘটেছিল
২০০৩ সালে বাড়িতে আগুন দিয়ে ১১ জনকে পুড়িয়ে মারার মামলাটির এখনও নিষ্পত্তি হয়নি৷ সেই পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য বিমল শীল আদালত, আইনজীবীসহ প্রশাসনের কর্তব্যক্তিদের কাছে বিচারের আশায় ছুটছেন ১৮ বছর ধরে।
২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় বাইরে থেকে ঘরে তালা লাগিয়ে গানপাউডার ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে পুড়ে মারা যান তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), তার স্ত্রী বকুল শীল (৬০), ছেলে অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২), অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল, তেজেন্দ্র শীলের ভাইয়ের মেয়ে বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), অ্যানি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয় দেবেন্দ্র শীল (৭২)।
অল্পের জন্য বেঁচে যান তেজেন্দ্র শীলের ছেলে বিমল শীল৷ পরে তিনিই বাদী হয়ে মামলাটি করেন। ২০১৯ সালের ২৩ জুন এই মামলার বিচার ছয় মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত। তারপরও পেরিয়েছে ২৮ মাস। কিন্তু বিচার শেষ হওয়া তো দূরের কথা, অর্ধশতের বেশি সাক্ষীর অর্ধেকের সাক্ষ্যও এখনও নেওয়া হয়নি।
বিমল জানান, ‘মামলা ঝিমিয়ে আছে। সাক্ষ্য গ্রহণ ঢিলেঢালা। চলতি বছর কোনো সাক্ষী (সাক্ষ্যগ্রহণ) হয়নি। ২২ জন সাক্ষী দিয়েছেন মোট। আশা করেছিলাম, আর কয়েকজন সাক্ষ্য দিলেই শেষ হবে। এখন যে অবস্থা এমনিতে সাক্ষী আসবে না। ওয়ারেন্ট করাতে হবে।
তিনি জানান, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সাক্ষী, যেমন: সে সময়ের বাঁশখালী থানার ওসি, তদন্তকারী পুলিশের এএসপি তাদের সাক্ষ্যই হয়নি। সরকারি আইনজীবীরা উদ্যোগী হয়ে এদের সাক্ষী করালেই বিচার এগিয়ে যায়।
এখন নিজের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত বিমল বলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা ওয়াদা করেছিল, তারা ক্ষমতায় গেলে বিচার হবে। গত এক যুগ ধরে আশায় বুক বেঁধে আছি। আশ্বাস দিয়েছিল যে নিরাপত্তা দেবে, ঘর দেবে। হয়নি। বাড়িতে একটা পুলিশ ক্যাম্প ছিল, সেটাও তুলে নিয়ে গেছে কয়েক বছর আগে।
মামলার বর্তমান অবস্থা
আলোচিত এই মামলা বর্তমানে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফেরদৌস ওয়াহিদের আদালতে বিচারাধীন। সাত তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার হ্লা চিং প্রু ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ডাকাতির উদ্দেশ্যে অগ্নিসংযোগ, খুন ও লুটতরাজের অভিযোগে ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটিতে সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নতুন অভিযোগ আনে।
এরপর ওই বছরের ১৯ এপ্রিল নতুন করে ওই ধারায় ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। ২০১২ সালের ১২ মে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওই বছরের ২ অক্টোবর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় ২০১৩ সালের নভেম্বর আবার তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি ফেরত আসে।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পিপি লোকমান হোসেন চৌধুরী বলেন, আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রয়েছে। দেরীর বিষয়ে তিনি বলেন, গত বছর বেশ কয়েক মাস বিচারক শূন্য ছিল। পরে করোনার কারণে লকডাউন ও আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
সাক্ষীদের পাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ইতিপূর্বে কয়েকজন সাক্ষীকে হাজির করতে ওয়ারেন্ট পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর হয়ত লকডাউনের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। আবার নতুন করে সমন করাতে হয়েছে।
এখন নিয়মিত বিচারক রয়েছেন জানিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণে গতি আসার আশা দেখান পিপি লোকমান। মামলার আসামিদের মধ্যে দুজন মাত্র কারাগারে আছেন, যাদের একজন গত জুনে আটক হয়েছেন; জামিনে আছেন ১৭ জন। বাকি ১৯ আসামি পলাতক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচারের এই দৈন্যদশাই বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আজ কোন অবস্থায় আছে। সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ক্ষেত্রে কীভাবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে, এ মামলা দেখলেই বোঝা যায়। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারপ্রার্থীর প্রতিকার না পাবার অবস্থা বিরাজমান। এতে প্রমাণিত হয়, দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি কীভাবে উৎসাহিত হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০৭
আপনার মতামত জানানঃ