বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে আফগানিস্তান। গত আগস্ট মাসে তালিবানরা দেশটির ক্ষমতা দখলের পর থেকে মানবিক পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হতে শুরু করেছে। দীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দেশটিকে সহায়তা করে আসছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে আগস্টে তালিবান ক্ষমতাচ্যুত করার পর ওই সব সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। আর এর ফলেই সমূহ বিপদে পড়েছে দেশটি।
এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতদিন যেসব আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি টিকে ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে এবং তালিবান সরকারের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
তালিবান নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের সিদ্ধান্তহীনতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। তালিবানের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তহীনতার ফল ভুগতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির লাখ লাখ মানুষকে।
সোমবার জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সতর্ক করে জানায়, আসছে শীতে অর্ধেকের বেশি আফগান চরম খাদ্যসংকটে ভুগবে। খাদ্যের অভাবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে, যদি না দ্রুতই আফগানিস্তানে ত্রাণ পাঠানো হয়।
বিবিসির সাংবাদিক ইয়োগিতা লিমায়ে ও তার দল সম্প্রতি আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত শহরের মেডিসিন্স সানস ফ্রন্ট্রিয়ার্স হাসপাতালের পাশাপাশি শহরটির গ্রামাঞ্চলে যান। হাসপাতালটি থেকে লিমায়ে বলেন, ‘বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আফগানিস্তানের কমপক্ষে ১০ লাখের বেশি শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে।
বিবিসি সাংবাদিক লিমায়ে জানান হেরাতের গ্রামাঞ্চলে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে আফগানরা অকল্পনীয় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। হেরাত অঞ্চল ঘুরে বিভিন্ন মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরা বিবিসির একটি ভিডিও প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, আর্থিক সংকটে পড়ে একটি পরিবারের পিতা-মাতা তাদের কন্যা শিশুকে ৫০০ ডলারে বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে, ওই পরিবারের নিরাপত্তার কারণে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
পরিচয় গোপন রেখে ওই মা লিমায়েকে বলেন, ‘আমার সন্তানরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছিল। এ কারণে আমার ছোট্ট মেয়েশিশুকে বিক্রি করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। আমি খুব খুশি হতাম যদি আমার মেয়েটাকে বিক্রি করা না লাগত।’
ওই মা বিবিসিকে আরও বলেন, ‘আমার বাকি ছেলে-মেয়েরা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। তাই একজনকে বিক্রি করে দিতে হয়েছে।’
লিমায়ে জানান, ওই মেয়েশিশুর বাবা আবর্জনা কুড়িয়ে সংসার চালাতেন। কিন্তু তা দিয়ে এখন আর সংসার চলছে না। শিশুটির বাবা বলেন, ‘ঘরে তেল, ময়দা কিছু ছিল না। অনাহারে দিন কাটছিল আমাদের। আমার মেয়ে আমার সম্পর্কে কী ভাবছে জানি না। তবে তাকে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’
লিমায়ে বলেন, ‘মেয়েটি একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত সে তার মা-বাবার কাছে থাকবে। এরপর যে ব্যক্তি তাকে কিনেছেন, তিনি মেয়েটিকে নিয়ে যাবেন। পরিবারটিকে বলা হয়েছে, ওই ব্যক্তির ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেয়া হবে। তবে এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়।’
বিক্রির শর্তে বলা হয়েছে, শিশুটি হাঁটা শিখলে ক্রেতা তাকে নিয়ে যাবেন এবং তার ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেবেন। ইতোমধ্যে বিক্রির ৫০০ ডলারের অর্ধেক টাকা পেয়েও গেছেন ওই পরিবার। যা দিয়ে কয়েক মাসের খাবার কিনতে পারবেন।
লিমায়ে বলেন, ‘এখানে আরও অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের দলের একজনের কাছে এক আফগান তার সন্তান বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, কতটা অসহায় হলে মানুষ এমনটা করতে পারে। এখানকার পরিস্থিতি বলার মতো নয়।
এদিকে আর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় তিন মাস বয়সী এক শিশু ওসমানের কথা। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে জন্মের সময় তার ওজন অনেক কম ছিল। তার বাবার হাতে এখন কোনো কাজ নেই। শুধু ওসমানের বাবা নয়, আফগানিস্তানের আরও লাখ লাখ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বেকার।
ওসমানের মা লিমায়েকে বলেন, ‘আমাদের হাতে কোনো অর্থ নেই। বিশ্ব যেন আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে, আমরা তা চাই। আমাদের শিশুরা কষ্টে আছে।’
এ ছাড়া ওই প্রতিবেদনে আরও দেখানো হয়, হেরাত অঞ্চলের কোনো হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা ৪ মাস ধরে বেতন পান না। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার মতো কেনো অর্থও নেই। ফলে রোগীরা ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন না।
লিমায়ে জানান, হেরাতের মেডিসিন্স সানস ফ্রন্ট্রিয়ার্সের আশপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে আর কোনো হাসপাতাল নেই। তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বড় অংশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, যা এখন বন্ধ। হেরাতের এই হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা গত চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। চিকিৎসাসামগ্রী কেনার মতো অর্থ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নেই।’
বিশেষজ্ঞরা বলছে আফগানিস্তানের এসব বিপন্ন মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শিগগিরই পৌঁছতে হবে। তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে কী হবে না, এ বিতর্কে আটকে গেলে এখানকার লাখ লাখ শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩২
আপনার মতামত জানানঃ