তালিবানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া মতাবলম্বী হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের শঙ্কা ছিল, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামলের মতো যদি তারা আবার জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়! তাদের শঙ্কাই যেন তালিবানের সাথে বাস্তবে ফিরে এসেছে। আফগানিস্তানের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষকে তাদের বাড়িঘর ও জমি ছেড়ে যেতে বাধ্য করছে তালিবান। যাদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তারা শিয়া হাজারা সম্প্রদায়ভুক্ত বা সাবেক আফগান সরকারের কর্মী-সমর্থক।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বরাত দিয়ে আজ শনিবার দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এভাবে উচ্ছেদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে হাজারা ও বিরোধীদের সমষ্টিগত শাস্তি দিচ্ছে তালিবান। দখল করা জমি ও ঘরবাড়ি তালিবান সমর্থকদের বিলিয়ে দিচ্ছে তারা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, দক্ষিণের কান্দাহার, হেলমান্দ ও উরুজগান, কেন্দ্রে দাইকুন্ডি এবং উত্তরের বলখ প্রদেশসহ ৫টি প্রদেশ জুড়ে এ উচ্ছেদ চলছে। অনেক মানুষকে মাত্র কয়েক দিনের নোটিশে এবং আইনি মালিকানা প্রমাণের কোনো সুযোগ দেওয়া ছাড়াই বাড়ি ও ফসলের খামার ত্যাগ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে বলা হয়েছে, চলে যাওয়ার আদেশ মেনে না নিলে তাদের ‘পরিণতি সম্পর্কে অভিযোগ করার অধিকার নেই।’
এ উচ্ছেদ এমন সময় করা হচ্ছে, যখন আফগানিস্তানে শীত আসন্ন এবং গ্রামাঞ্চলের পারিবারগুলো ঘরে ফসল তোলায় ব্যস্ত। এ ফসলের ওপরই তাদের সারা বছরের খাওয়া-পরা নির্ভর করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়ার সহযোগী পরিচালক প্যাট্রিসিয়া গসম্যান বলেছেন, ‘সমর্থকদের পুরস্কৃত করার জন্য জাতিগত বা রাজনৈতিক মতামতের ভিত্তিতে হাজারা ও অন্যদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করছে তালিবান। জোরপূর্বক হুমকি দিয়ে এবং কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া এসব উচ্ছেদ গুরুতর অপব্যবহার, যা সমষ্টিগত শাস্তির সমান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে শস্য কাটার সময় এবং শীত শুরু হওয়ার ঠিক আগে পরিবারগুলোকে বাস্তুচ্যুত করা নিষ্ঠুর কাজ হয়েছে। তালিবানের উচিত হাজারা ও অন্যান্যদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা বন্ধ করা এবং আইন ও ন্যায্য প্রক্রিয়া অনুযায়ী জমি সংক্রান্ত বিরোধের বিচার করা।’
গত আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর তালিবান একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পশতুন নৃগোষ্ঠীর সুন্নি আলেম প্রভাবিত একটি পুরুষ মন্ত্রিসভা বেছে নিয়েছে তারা। প্রতিশোধমূলক হত্যা, সাংবাদিকদের উপর হামলা, নারী অধিকার হরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তালিবানের বিরুদ্ধে।
দক্ষিণের কান্দাহার, হেলমান্দ ও উরুজগান, কেন্দ্রে দাইকুন্ডি এবং উত্তরের বলখ প্রদেশসহ ৫টি প্রদেশ জুড়ে এ উচ্ছেদ চলছে। অনেক মানুষকে মাত্র কয়েক দিনের নোটিশে এবং আইনি মালিকানা প্রমাণের কোনো সুযোগ দেওয়া ছাড়াই বাড়ি ও ফসলের খামার ত্যাগ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে বলা হয়েছে, চলে যাওয়ার আদেশ মেনে না নিলে তাদের ‘পরিণতি সম্পর্কে অভিযোগ করার অধিকার নেই।’
তালিবানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। দেশটির সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছে গোষ্ঠীটি। আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ১৩ সদস্যকে হত্যা করেছে দেশটির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালিবান।
তবে চলতি বছর হাজারাদের ওপর তালিবানের চালানো হত্যাকাণ্ড এটিই প্রথম নয়। গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার আগে গত জুলাই মাসে দেশটির গজনি প্রদেশে হাজারা সম্প্রদায়ের ৯ ব্যক্তিকে হত্যা করে তালিবান।
বর্তমানে আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে ২০ শতাংশ শিয়া সম্প্রদায় হাজারা সংখ্যালঘু। হাজারারা চেঙ্গিস খানের বংশধর হিসেবে পরিচিত। দিনের পর দিন এ সম্প্রদায়ের মানুষ পশতুনদের কাছে বঞ্চনা ও নিগৃহের শিকার হচ্ছে।
আফগানিস্তানের প্রতাপশালী পশতুন জনগণ হাজারাদের কখনো তাদের সমতুল্য মনে করতে পারেনি। হাজারারা শিয়া। পশতুনরা সুন্নি। ধর্মকেন্দ্রীক এ মতভেদ এবং হাজারাদের নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার কারণে কখনো আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়।
বেসামরিক সরকার হাজারাদের কথা শোনার চেষ্টা করলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে জঙ্গিদের কিলিং মিশনের টার্গেটে পরিণত হয় হাজারারা। তালিবান থেকে শুরু করে যেকোনো সুন্নি উগ্রবাদীরা হাজারাদের মুসলমান মনে করে না।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তালিবান কমান্ডার মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ সমবেত সুন্নি জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘হাজারারা মুসলিম নয়, তাদের হত্যা কর।’ এরপর তাদের ওপর চরম নিপীড়ন চলতে থাকে। তালিবান সরকারের সময় হাজারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
হত্যা-নির্যাতনের ভয়ে অনেক হাজারা শিয়াপ্রধান দেশ ইরানে পালিয়ে যায়। আর যারা মাটির মায়া ছাড়তে না পেরে থেকে যায়, তাদের ভাগ্যে জোটে নির্মম অত্যাচার। ১৯৯৮ সালে মাজার-ই শরিফে ষড়যন্ত্র করে কয়েক হাজার হাজারাকে হত্যা করা হয়। তালিবান ও আল-কায়েদার জঙ্গিরা সুযোগ পেলে হাজারাদের রক্তে হাত রাঙাতে দ্বিধা করে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৩
আপনার মতামত জানানঃ