৭৭ হাজার বিঘা জমি দখল করে বিশাল একটি শিবমন্দির কমপ্লেক্স বানানোর লক্ষ্যে সেখানকার মুসলিমদের উপর দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে আসাম সরকার। এই অভিযানে দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাও গেছেন, আহত হয়েছেন অনেকেই।
বিবিসির সূত্র মতে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের দরং জেলায় একটি সুবিশাল শিবমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার পর বৃহস্পতিবার সেই আশ্রয়চ্যুতদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালিয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিকরা পুলিশের গুলিতে অন্তত দুজনের মৃত্যু ও আরও বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর জানাচ্ছেন। রাজ্যের বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতিও এই হত্যাকান্ডের খবর টুইট করেছেন।
সূত্র মতে, গতকাল বৃহস্পতিবার রীতিমতো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে নামে পুলিশ। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর এলাকার মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। পুলিশের দাবি, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে অস্ত্র ছিল। তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল।
যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠি এবং পাথর ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, প্রথমে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে শূন্যে গুলি চালানো হয়। কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটানো হয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পাল্টা পুলিশের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে বাধ্য হয়েই গুলি চালাতে হয়। তাতেই দুইজনের মৃত্যু হয়।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দরং জেলার ধলপুর গ্রামে একটি প্রাচীন শিবমন্দিরকে অনেক বড় আকারে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত কয়েক মাস ধরেই আসাম সরকার সেখানে দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে, যদিও সেই ভিটেমাটি-হারানোরা দাবি করছেন তাদের সব ধরনের সরকারি নথি ও পরিচয়পত্রই আছে।
সূত্র মতে, আসামের দরং জেলার ধলপুর হিলস ও সিপাহঝাড় এলাকায় প্রায় ৭৭ হাজার বিঘা জমি দখল করে বিশাল একটি শিবমন্দির কমপ্লেক্স বানানোর লক্ষ্যে রাজ্য সরকার সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে বেশ কয়েক মাস ধরেই।
সেই অভিযানের সবশেষ ধাপে গত সোমবার ওই অঞ্চলের বাসিন্দা প্রায় আটশো পরিবারের বেশ কয়েক হাজার মানুষকে তাদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে সেই জমি খালি করিয়ে দেওয়া হয়। তার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দরংয়ে উচ্ছেদ-বিরোধী কমিটির জমায়েতে পুলিশ গুলি চালালে অনেকে হতাহত হয়েছেন।
As news pours in of d tragedy by police bullets in Dhalpur, Darrang dist of Assam; one more life may have been lost (taking d toll to 3) here r some photos to show how a Peaceful protest, an abs right under Article 19(1)(a) of the Indian Consti ws violently taken away #Assam pic.twitter.com/kXQ2GfZaLn
— Teesta Setalvad (@TeestaSetalvad) September 23, 2021
স্থানীয় সাংবাদিক দেবব্রত দত্ত বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যে সেল গড়ে তোলা হয়েছে তাদের ডাকে ধলপুর ১, ২ ও ৩ নম্বর গ্রামের বেশ কয়েক হাজার মানুষ আজ জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে পুলিশের হামলায় অন্তত জনাদশেক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে আমরা জানতে পারছি।”
তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে অন্তত দুজন নিহত হয়েছেন, একজনের লাশের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “পরিস্থিতি ওখানে অগ্নিগর্ভই ছিল, স্থানীয় নেতারা গতকালই আমাকে বলছিলেন তাদের লড়াই তারাই লড়বেন; বিরোধী কংগ্রেস বা এআইডিইউএফ নেতারা ঢুকতে গেলে পেটাবেন, এবং কোনও রাজনীতি করতে দেবেন না।”
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আসামের কংগ্রেস প্রধান ভূপেন কুমার বোরা এই হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দেন। তবে তখনও পুলিশ বা রাজ্য সরকার গুলি চালনার কথা স্বীকার করেনি। নিহত একজনের ছবিও টুইট করেন ভূপেন কুমার বোরা।
এদিকে বুধবার ঘটনাস্থল ঘুরে আসা দেবব্রত দত্ত জানাচ্ছেন, এই উচ্ছেদ হওয়া মানুষরা প্রায় সবাই বাঙালি মুসলিম যারা বহু দশক ধরে ধলপুরের চরাঞ্চলেই বসবাস করছেন।
তাদের একজন রহিমা শেখ বলছিলেন, “নদীর বুকেই বারবার ঘর বাঁধি আর সেই নদীর বুক থেকেই বারবার আমাদের খ্যাদায়ে দেয়। অথচ আমাদের কাগজপাতি সব আছে; এনআরসি, প্যান কার্ড। নিজেরা খাই বা না-খাই সরকারি খাজনা ঠিকই দিয়ে যাচ্ছি।”
আরও বলেন, “সেই তিরাশি সালেরও কত আগে থেকে আমরা এখানে থাকতেসি। তহন এইহানে মন্দির-টন্দির কিসুই আসিল না, ছোট্ট একটা পাহাড় আসিল শুধু!”
পাশ থেকে জাহানারা বেগম যোগ করেন, “রাত জেগে আমরা ঘর বানায়ছিলাম। আমরা দুখিয়া মানুষ। এখন মন্দিরের দাবি কইর্যা আমাগো খ্যাদায় দিল।”
আর এক গ্রামবাসী হাসনু আরাও কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “বড়ো দুঃখু পাইসু। আমি এতিয়া, মাটিবাড়ি নাই; এখন কইত যাম?”
উচ্ছেদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা সেলের নেতা নিয়ামত শেখ বা জাহাঙ্গীর আলমরাও জানাচ্ছেন, তারা প্রত্যেকে দেশের বৈধ নাগরিক ও বহু বছর ধরে সরকারি খাজনা দিয়ে আসছেন। তারপরেও তারা বিজেপির রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। এ সময় নিয়ামত শেখ যেমন নিজের দাবির স্বপক্ষে ২৬ আগস্ট, ১৯৮৪ সালে দেওয়া একটি খাজনার রসিদও তুলে ধরেন।
Today I visited Gorukhuti in Sipajhar, Darrang with Industry Minister @cmpatowary, MLA @paramarajbongsi and former MLA @gurujyoti_das and traveled in a country boat to inspect the riverine areas that were encroached by illegal settlers near Dholpur Shiva Mandir. 1/3 pic.twitter.com/ICaA7saX3o
— Himanta Biswa Sarma (@himantabiswa) June 7, 2021
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উচ্ছেদ হওয়া প্রত্যেকের এনআরসিতে নাম আছে। লিগ্যাসি ডেটা আছে। এই অঞ্চলে বহু সরকারি প্রাথমিক স্কুল আছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আছে। তারপরেও কীভাবে আমরা অবৈধ হই?
গোটা বিষয়টিকে চরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের ওপর বিজেপির ‘নির্মম অত্যাচার’ হিসেবেই দেখছেন তিনি। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এই উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে, সেটা হল ওই এলাকার একটি প্রাচীন শিবমন্দিরকে নতুন করে গড়ে তোলা।
শিবমন্দিরটি বড়জোর তিন-চারশো বছরের পুরনো বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা এবং আসামের একটি প্রভাবশালী নিউজ পোর্টালের সম্পাদক আফরিদা হুসেইন মনে করেন এখানে আর যাই হোক সরকারের উদ্দেশ্য সৎ নয়।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকারের উদ্দেশ্যকে আমি সঠিক বলতে পারব না, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে খুশি করতেই এই সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমি নিজে ধলপুরে গেছি, কিন্তু সেই মন্দির সুপ্রাচীন যুগের; এমন কোনও প্রমাণই পাইনি।”
তিনি আরও বলেন, “তা ছাড়া মন্দিরটিকে ঘিরে হাজার হাজার মুসলিম পরিবার বহু বছর ধরে বাস করছে, আগে কোনওদিন অশান্তি হয়নি। এমন কী মন্দির কর্তৃপক্ষ বহু মুসলিম পরিবারকে চাষবাস ও খামার করার জন্য জমিও দিয়েছিল।”
এদিকে, জুন মাসে প্রথম দফা উচ্ছেদের পর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ঘটনাস্থল পরিদর্শনেও যান। ফিরে এসে তখন তিনি টুইট করেন, ধলপুর শিবপুরের কাছে বিস্তীর্ণ এলাকা কীভাবে অবৈধ বসতিস্থাপনকারীরা দখল করে রেখেছিল তা আমি সরেজমিনে দেখে এসেছি!
মানবাধিকারকর্মীদের বক্তব্য, একের পর এক উচ্ছেদ অভিযানে এভাবেই বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে পুলিশ এবং প্রশাসন। সরকার তা সমর্থন করছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনার পরেও মুখ্যমন্ত্রী তার সমালোচনা করেননি বলেও অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ কেন বুক লক্ষ্য করে গুলি চালালো, সে প্রশ্নও উঠছে।
আসামের সাংবাদিক এবং বরাক বুলেটিনের অন্যতম প্রধান অনির্বাণ রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, “মুসলিম বিদ্বেষের কদর্য প্রকাশ এদিনের ঘটনা। যেভাবে পুলিশ গুলি চালিয়েছে, যেভাবে নিহত ব্যক্তির উপর আক্রমণ হয়েছে, তা ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। ৪৮০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অথচ তাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। কার্যত অনাহারে দিন কাটাচ্ছে তারা। মুখ্যমন্ত্রীর টুইট দেখে মনে হচ্ছে, তিনি আনন্দিত।”
শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চার্বাক কানান, উচ্ছেদের নামে মুসলিম এবং বাঙালি বিদ্বেষের এক চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে আসাম। এমন চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩০৬
আপনার মতামত জানানঃ