সাম্প্রদায়িকতার ছায়ায় থেকে ধর্ম অবমাননার নামে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা এদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে আজ স্বাভাবিক ঘটনার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। তার উপর দেশের মানুষের বাক স্বাধীনতায় সরকারের সর্বশেষ বিধিনিষেধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এক আইনেই কিস্তিমাত। সরকারের সমালোচনা নেই বললেই চলে। বিতর্কিত এই আইন নিয়ে দেশে এবং বিদেশে তুমুল বিতর্কিত হলেও, এর অপপ্রয়োগ রোধে কোন ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়নি বরং প্রয়োগ বেড়েছে কয়েকগুণ। শাল্লাহ’র ঝুমন দাসও এই আইন আর দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতির বলি।
সুনামগঞ্জের শাল্লাহ’র ঝুমন দাস ধর্ম ব্যবসায়ী মামুনুল গংদের সন্ত্রাসমূলক নৈরাজ্য নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এর ফলে মামনুলের উগ্রবাদি ভক্তরা হবিবপুর ইউনিয়নের নওগাঁও গ্রামে হামলার পরিকল্পনা করে যা স্থানীয় পুলিশের আগে থেকেই জানা ছিল। তখন সম্ভাব্য হামলা থেকে বাঁচতে গ্রামবাসীই ঝুমন দাসকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
আগাম সব তথ্য থাকার পরও হামলা ঠেকানোর ব্যবস্থা না নিলেও পুলিশ ঝুমন দাসকে প্রথমে ৫৪ ধারায় আটক দেখায়। তারপরও নওগাঁও গ্রামের সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়িতে মামুনুলের ভক্তরা হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। এই হামলার ঘটনায় প্রমাণিত হয় ঝুমন দাসের ফেসবুক পোস্ট অসত্য ছিল না। তবুও পুলিশ ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পাঁচ দিন পর।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে শানে রিসালত সম্মেলন নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এতে হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বক্তব্য দেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আগে থেকেই সমালোচনায় ছিলেন মামুনুল হক। দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় দিরাইয়ের সমাবেশে এসে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন মামুনুল হক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করতে গিয়ে সাম্প্রাদায়িক বিদ্বেষমূলক বক্তব্যও রাখেন।
এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা শাল্লার নওগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাস আপন। স্ট্যাটাসে তিনি মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ আনেন। আর এটাই পরবর্তীতে রূপ নিয়েছে ধর্ম অবমাননার। মামুনুল হকের ওই অবস্থানের কারণে তার বিরুদ্ধে সরকারের অসন্তোষ ছিল স্পষ্ট। মামুনুলের বিরুদ্ধে ঝুমনের ওই অভিযোগ ছিল সরকারি দলেরও। তবু কেন ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হলো? কেন পাঁচ মাসে সাত বার চেষ্টায়ও জামিন পায় না ঝুমন দাস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর কারণ মূলত দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষা। ঝুমন দাস হচ্ছেন সরকারের সেই চাল; যাতেও সাপও মরেছে, লাঠিও ভাঙেনি। ঝুমনের আটক থাকা দেশের বড় একটা জনগোষ্ঠীকে ওই ঘটনা নিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে। মূলত রাজনীতির বলি আমাদের ঝুমন দাস।
ঝুমনকে মুক্ত করতে গত পাঁচ মাসে সাত বার জামিনের আবেদন করা হয় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, জজকোর্ট ও হাইকোর্টে। সব আদালতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অথচ ঝুমনের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দিতে পারেনি এখনো।
৫৪ ধারায় প্রথমে আটক করলেও সুনামগঞ্জ পুলিশ পাঁচ দিন পরে ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে বিতর্কিত এই আইনের চরম অপব্যবহার করে। বিনা বিচারে পাঁচ মাস ধরে ঝুমন দাসের মতো একজন নিরীহ মানুষ কারাভোগ করছেন। ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টের কারণে গ্রেপ্তার ঝুমনের জামিন সাত বার প্রত্যাখ্যানই প্রমাণ করে রাষ্ট্র কতটা অমানবিক আচরণ করছে তার সঙ্গে।
অথচ ঝুমনকে হেফাজতে নেওয়ার পরও নওগাঁও গ্রামে হামলা চালানো হয়। পরবর্তীতে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগে মামুনুলের অনেক সহযোগীকে সরকার গ্রেপ্তার করে। ঝুমন দাসদের গ্রামে হামলাকারীদের মধ্য থেকে গ্রেপ্তার ৫২ জনই পরবর্তীতে জামিনে বের হয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে ঝুমন দাসের আইনজীবী অ্যাডভোকেট দেবাংশু শেখর দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এ পর্যন্ত সাত বার জামিনের আবেদন করেছি। হাইকোর্টেও করেছি। কিন্তু জামিন হয়নি। হাইকোর্ট জামিন না দেয়ায় এখন আবার আইন অনুযায়ী নিম্ন আদালতে জামিন আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
তিনি আরো বলেন, “মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না, জামিনও পাচ্ছি না। মামলায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কটুক্তি করায় ধর্ম অবমামনার অভিযোগ আনা হয়েছে।”
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা ধর্ম অমাননা কিনা- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সেটা তো আইন আদালতের বিষয়। তবে ওই গ্রামে হামলা হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। এর সাথে ধর্ম অবমাননার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করি।”
ঝুমন দাসের স্ত্রী এবং ১১ মাস বয়সের একটি কন্যা শিশু রয়েছে। ঝুমন দাস কারাগারে থাকায় তারা নানা সংকটের মধ্যে রয়েছেন। ঝুমন দাসের স্ত্রী সুইটি রানী দাস বলেন, “মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কিছু বললে তাতে ধর্মের অবমাননা হয় কীভাবে? সরকারেরও তো অনেক মন্ত্রী এমপি মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাহলে তারাও তো অপরাধ করেছেন। তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হয় না? আমিও বলেছি, আমাকেও গ্রেপ্তার করা হোক।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘যারা হামলা করলো তাদের সবাই জামিন পেয়ে মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু আমার স্বামী ঝুমন দাস জামিন পান না। তাকে এখনো কারাগারে রাখা হয়েছে। এটা কেমন বিচার? কেমন আইন?”
এ প্রসঙ্গে নওগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস বলেন, ঝুমন কোনো ধর্ম, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয় নাই। সে একজন ব্যক্তির সমালোচনা করেছে। এ কারণে তাকে তথ্য-প্রযুক্তি মামলা দিয়ে জেলা রাখা যুক্তিসঙ্গত নয়। আমরা তার মুক্তি চাই।
এটা পরিষ্কার যে ঝুমন দাস কোনোভাবেই ধর্মকে অবমাননা করেনি। মামুনুল হক একজন ব্যক্তি এবং তার বিরুদ্ধে অসংখ্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে, এমনকি রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধেও তার অনেক বক্তব্য আছে। একজন রাষ্ট্রবিরোধীর বিরুদ্ধে লিখলে সেটা ধর্মের অবমাননা কেন হবে?
ঝুমনের সাথে যা হয়েছে, সেটা নাগরিক অধিকারের অবমাননা। ঝুমন দাস তার ন্যূনতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাঁচ মাসেও এই একটি মামলার তদন্ত কেন শেষ হচ্ছে না? এর পেছনে কার অবহেলা বা কাদের স্বার্থ জড়িত? ঝুমন দাস কেবল হিন্দু বলেই কি তাকে আটকে রাখা হয়েছে?
পাশাপাশি দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সহায়তায় যেভাবে নিরপরাধীদের হেনস্তা করা হচ্ছে সেটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আর ‘অনুভূতি’ কথাটি সম্পূর্ণ একটি বায়বীয় কথা। এর কোনও নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এ ধরনের বায়বীয় বিষয় নিয়ে আইনের কোনও ধারা কি নির্ধারণ করা যায়? ধর্মীয় অনুভূতি মূলত কী, এর পরিসীমা কতটা তার সুস্পষ্টতা প্রয়োজন।
মূলত, শাল্লার নওগাঁওয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বসতিতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। এর আগেও কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বসতিতে, যশোরের মালোপাড়া, ঠাকুরগাঁওয়ের গড়েয়া-কর্ণাই, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের পাগলাপীর, ভোলার বোরহানউদ্দিন, কুমিল্লার মুরাদনগরসহ বিভিন্ন স্থানে একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম ও মহানবীকে কটাক্ষ করে পোস্ট দিয়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অজুহাত দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
আর এক্ষেত্রে দেশের আইনও যে আজ দলকানাদের মধ্যে গিয়ে ভিড়েছে, তার প্রমাণ ঝুমন দাসের জামিন না পাওয়া। সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার সংস্কৃতি লালন করছে এদেশের রাজনীতি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আজ তাই শুধু শাব্দিক তাৎপর্য বহন করে। এর আজ আর কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯১৪
আপনার মতামত জানানঃ