চল্লিশ হাজার বছর আগে ইউরোপে আমরাই একমাত্র মানব প্রজাতি ছিলাম না। আরও তিন প্রজাতির বাস ছিলো তখন। মানুষের এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে বর্তমান মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের প্রজাতি হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে তারা বাস করত। আজ থেকে প্রায় ৪০ বা ৪২ হাজার বছর আগে এ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় তারা।
আজ থেকে ৪০ বা ৪২ হাজার বছর আগে পৃথিবীর মেরুদ্বয়ের প্রান্ত বদলের কারণেই অতিকায় স্তন্যপায়ী প্রজাতি মেগাফনা ও নিয়ান্ডারথাল মানবরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। নিয়ান্ডারথাল প্রজাতি প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানবজাতির সঙ্গে কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ, তা নিয়ে এখনো রয়েছে নানা বিতর্ক। কিন্তু সম্প্রতি স্পেনে পাওয়া গুহাচিত্র প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নিয়ান্ডারথালদের মধ্যেও শিল্পের প্রতি অনুরাগ ছিল! আর এটিই আদিম মানুষের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালদের নৈকট্য আরও এক ধাপ এগিয়ে এনেছে। খবর রয়টার্স
স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশ মালাগার কাছেই অবস্থিত ‘কেইভস অফ আর্দালেসে’র স্ট্যালাগমাইটস (গুহার মেঝে থেকে ওপরের দিকে উঠে যাওয়া পাথুরে স্তম্ভ বিশেষ) এর উপর রেড ওকার নামক রঙের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
গবেষকদের মতে, এটি ৬৫ হাজার বছর আগে নিয়ান্ডারথাল মানবদের আঁকা। আর তাই যদি হয়, তাহলে তারাই হতে পারে পৃথিবীর প্রথমশিল্পী। প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস (পিএনএএস)-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়।
এরকম দাবি করার পেছনে কারণ হলো, গুহাচিত্রগুলো যখন আঁকা হয়েছে; তখনো আধুনিক মানুষ এই পৃথিবীতে বসতি গড়ে তুলতে পারেনি। প্রায় ৪০ থেকে ৪২ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ান্ডারথাল যে হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো গোত্রের ছিল না, নতুন এ গবেষণা তা প্রমাণ করে।
মালাগার এই গুহার ভেতরের চিত্রগুলো ১৫ থেকে ২০ হাজার বছর সময়কালের ব্যবধানে বিভিন্ন সময়ে আঁকা হয়। এর আগে একই গুহা পর্যবেক্ষণ করে গবেষকরা জানিয়েছিলেন যে, চিত্রগুলো হয়তোবা প্রাকৃতিক অক্সাইডের কারণে তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু এবার তারা সেই বক্তব্যকে নাকচ করে দিয়ে জানান, এগুলো আসলে মানুষেরই আঁকা।
পিএনএএস গবেষণার একজন লেখক, জোয়াও জিলহাও বলেন, “লালচে বাদামিরঙা ওকার পিগমেন্টেশনের মাধ্যমে স্ট্যালাগমাইটসে ছবিগুলো আঁকা হয়েছে। খুব সম্ভবত কোনো রীতির আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে তারা ছবিগুলো আঁকে।”
তিনি আরও বলেন, “মূল বিষয়টা হলো, এই উদ্ভাবনের ফলে নিয়ান্ডারথালদের প্রতি আমাদের মনোভাব বদলে যাবে। মানবজাতির সঙ্গে তাদের সত্যিই ভালো যোগসূত্র রয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তারা বিভিন্ন বস্তু পছন্দ করতো। মানুষের সঙ্গেও তারা সঙ্গম করেছে। আর এখন আমরা দেখাতে পারবো যে তারা ছবিও আঁকতো।”
এর আগে ফ্রান্সের শোভে-পঁ দা’র্ক গুহায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের আঁকা দেয়ালচিত্র পাওয়া যায়; যা ছিল ৩০ হাজার বছরেরও বেশি পুরানো।
মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে নিয়ান্ডারথালদের সম্পর্কেই সব থেকে বেশি তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ান্ডারথাল উপত্যকা থেকে পাওয়া এক ফসিলের নাম জায়গার নামে রাখা হয় নিয়ান্ডারথাল মানুষ। নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে সাধারণ মানুষদের সাদৃশ্য রয়েছে অনেকটাই।
জেনেটিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, আমাদের ডিএনএ’র সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে তাদের। কিন্তু ইউরোপ ও এশিয়ায় বসবাসকারী নিয়ান্ডারথালরা কেন আজ থেকে প্রায় ৪০ থেকে ৪২ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছিলো তা আজও স্পষ্ট নয়। নানা মত রয়েছে। এমনকী, হোমো স্যাপিয়েন্সদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পেরে হারিয়ে যাওয়ার থিওরিও রয়েছে। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ এক ভিন্ন দাবি করতে দেখা গেলো বিজ্ঞানীদের।
কারা এই নিয়ান্ডারথাল?
প্রথম ১৮২৯ সালে বেলজিয়ামের এঞ্জিসের কাছাকাছি গুহা থেকে একটি নিয়ান্ডারথাল শিশুর মাথার খুলি আবিষ্কার করা হয়। তারপর থেকে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ফসিল পাওয়া গেছে যা কয়েকশো নিয়ান্ডারথাল ব্যক্তির অবশেষের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মধ্যে বাচ্চা, শিশু এবং ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্কর ফসিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নিয়ান্ডাথালদের বিকাশ ঘটেছিলো ইউরোপ এবং এশিয়াতে। পক্ষান্তরে বর্তমান মানুষের প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিলো আফ্রিকাতে। ফসিল গবেষণা করে বিজ্ঞানী ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা দেখেছেন যে, নিয়ান্ডারথালদের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ বছর আগে ইউরোপে। এই প্রজাতিটি ইউরেশিয়া, পশ্চিম পর্তুগাল এবং ওয়েলস থেকে সাইবেরিয়ার আলটাই পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
জিব্রাল্টারে নিয়ান্ডারথালদের কিছু বসতি ছিল। সেখানকার আইবেরিয়া প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট বিশ্লেষণে জানা গেছে, আধুনিক মানুষের চেয়েও বনভূমির পরিবেশে ভালো শিকারি হিসেবে অভিযোজিত নিয়ান্ডারথালরা গরম কাপড় পরতো, ভয়ঙ্কর শিকারি ছিল এবং তাদের অত্যাধুনিক পাথরের হাতিয়ার ছিল। তাদের অস্ত্র বড় প্রাণী শিকারের উপযুক্ত ছিল। এমনকি চকমকি পাথরে কুঠার তৈরি করে খরগোশের মতো ছোট প্রাণীও শিকার করতে পারতো তারা। মৃত পশুর মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ দিয়ে উড়ন্ত পাখি শিকারের মতো বুদ্ধিও অর্জন করেছিল।
ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ২ লক্ষ বছর যাবৎ নিয়ান্ডারথালরা রাজত্ব করেছে। আনুমানিক ১ লক্ষ বছর পূর্বে আদিম-আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। ৪০ থেকে ৫০ হাজার বছর পূর্বে তাদের সাথে দেখা হয় নিয়ানডার্থালদের। ভাবতেই অবাক লাগে পৃথিবীর বুকেই আমাদের মত বুদ্ধিমান আরেকটি প্রজাতির সাথে আমরা একসাথে প্রায় ৩০,০০০ বছর পার করেছিলাম।
ফসিল রেকর্ড অনুসারে এটা নিশ্চিত যে, ২৮,০০০ বছর পূর্বে তাদের শেষ আস্তানা থেকেও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো নিয়ান্ডারথালরা। শেষ আস্তানা ছিলো জিব্রাল্টার, আইবেরীয় উপদ্বীপের শেষ প্রান্তে অবস্থিত বর্তমান ব্রিটেন সরকার শাসিত অঞ্চল। বর্তমান স্পেন, পর্তুগাল, অ্যান্ডোরা এবং জিব্রাল্টার অঞ্চলগুলো নিয়েই আইবেরীয় উপদ্বীপ। এখানকার অপেক্ষাকৃত সহনশীল জলবায়ু এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিচিত্র সমাহারই বোধহয় নিয়ান্ডারথালদের টেনেছিলো।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ