আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে দুটি বোমা বিস্ফোরণ শুধু কাবুলকেই নাড়িয়ে দেয়নি, নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্ব। এই বোমা বিস্ফোরণ মূলত জানিয়ে দিল, আফগানিস্তান এক দীর্ঘমেয়াদি রক্তপাত আর অস্থিরতার গহ্বরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসহ ১০০ এর অধিক আফগান বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন ১৫০ জনেরও বেশি। বোমা বিস্ফোরণের পর এক বিবৃতিতে হামলার দায় স্বীকার করে নেয় ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এর আগে সতর্ক করে জানিয়েছিল, কাবুল বিমানবন্দরে চলমান চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আইএস-কে) হামলা চালাতে পারে। বর্তমান নিরাপত্তা সংকটের সুযোগ আইএস-কে নিতে পারে বলে চলতি মাসের শুরুর দিকেও সতর্ক করা হয়।
সূত্র মতে, আইএসের অঙ্গসংগঠন আইএস-কে তালিবানের চরম বিরোধী শক্তি। যদিও শত্রুর ছায়া মিত্র কিনা, এ নিয়ে যুক্তিযুক্ত বিবাদ আছে। তা সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর আইএস-কেকে নির্মূলের চেষ্টা তালিবান করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে আল-কায়েদার মতো সন্ত্রাসী কোনো সংগঠনকে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা চালাতে দেবে না তালিবান- এই শর্তে দেশটি থেকে সব সেনা প্রত্যাহারে গত বছর রাজি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আইএস-কের সঙ্গে তালিবানের বিরোধের উৎস কী? সম্পর্ক কী? আর আফগানিস্তানে কতটা শক্তিধর এই সংগঠন?
আফগানিস্তানে আইএস-কের হুমকি কতটা
নীতিনির্ধারণীবিষয়ক সংস্থা এশিয়া প্রোগ্রামের উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘আফগানিস্তানে আইএস-কে নিশ্চিতভাবে ফের শক্তিশালী হবে। তবে এখনই তারা দূরের কোনো লক্ষ্যে হামলা চালাতে পারবে না।’
তবে আইএসের উপস্থিতি তালিবানকে অস্তিত্ব সংকটে ভোগায়। দীর্ঘদিন ধরে আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে তালিবান। গত সপ্তাহে বাইডেন বলেছিলেন, তালিবান ও আইএসের মধ্যে মিল হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মাইকেল কুগেলম্যান জানান, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সুযোগ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ছাড়বে না। স্থানীয় পর্যায়ে হামলার পাশাপাশি সিরিয়া বা ইরাকের পরিবর্তে এখন আফগানিস্তানে আস্তানা গাড়তে পারে এসব সংগঠন।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, আফগানিস্তানে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের ৮ থেকে ১০ হাজার যোদ্ধা এ মুহূর্তে অবস্থান করছে।
আইএস-কে ও তালিবানের সম্পর্ক
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আফগানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সেথ জোনস বলেন, ‘আইএস ও আইএস-কের লক্ষ্য ইসলামিক আমিরাত প্রতিষ্ঠা। তালিবানও ইসলামিক আমিরাতের কথা বলে। তা সত্ত্বেও আল-কায়েদা ও তালিবানের প্রতিদ্বন্দ্বী আইএস ও আইএস-কে।
যদিও সম্পদ ও অঞ্চল নিয়ে তালিবান ও আইএস-কের মধ্যে অহরহই সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের অন্যতম কারণ মতাদর্শগত ভিন্নতা বলে প্রচার করা হলেও, তার যৌক্তিক কারণ স্পষ্ট নয়। তবে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ভাষ্য, ‘মতাদর্শগত ভিন্নতা ও সম্পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা তালিবান ও আইএস-কের মধ্যকার শত্রুতার মূল কারণ।
তালিবানের বিরুদ্ধে আইএস-কের অভিযোগ, ইসলামের সর্বজনীন বিশ্বাসের মাধ্যমে জনমনে আস্থা তৈরি না করে সংকীর্ণ জাতিগত ও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তালিবান জনমনে বৈধতা অর্জন করে।
সিএনএন বলছে, তালিবানর জাত শত্রু আইএস-কে। ফোর্বসও একই কথা বলছে। কিন্তু বিবিসি বলছে ভিন্ন কথা। এই সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তালিবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আইএস-কে। সেই সংগঠনটি হলো হাক্কানি নেটওয়ার্ক।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তালিবানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক রয়েছে। হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি তালিবানেরও নেতা।
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের হয়ে কাজ করছেন সাজান গোহেল। আফগানিস্তানের জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। তার কথায়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু হামলা তালিবানের হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও আইএস-কে একসঙ্গে চালিয়েছে।
তালিবানের সঙ্গে আইএস-কের যে সম্পর্ক রয়েছে, তার আরেকটি প্রমাণ মেলে তালিবানের সাম্প্রতিক এক পদক্ষেপে। ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর পুল-ই-চরকি কারাগারের তালা খুলে দেয় তারা। সেই কারাগারে যারা ছিলেন, তাদের অধিকাংশ আল-কায়েদা ও আইএসের সদস্য। এ থেকে বিশ্লেষকদের অনুমান, ভেতরে–ভেতরে তালিবানের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে আইএসের এই শাখার।
আফগানিস্তানে আইএসের উপস্থিতি
২০১৪ সালে আইএসের তৎকালীন প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির প্রতি আনুগত্য জানান পাকিস্তানি হাফিজ সাঈদ খান। সাঈদের হাত ধরে বেশির ভাগ পাকিস্তানি যোদ্ধা নিয়ে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় নানগারহার প্রদেশে ছোট সংগঠন হিসেবে আইএস-কের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। পাকিস্তানি তালিবান ও আফগান তালিবানের কয়েকজন যোদ্ধাও ওই সময় আইএস-কেতে যুক্ত হয়।
ইরাক ও সিরিয়ায় ঘাঁটি থাকা আইএসের মতো আইএস-কেও আফগানিস্তানের পুরো অঞ্চল দখল করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে কাজ করা শুরু করে আইএস-কে।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেন, সিরিয়া ও ইরাকে আইএস অঞ্চল হারানোর পর আফগানিস্তানে তাদের অঙ্গসংগঠন আইএস-কের হাতে সন্ত্রাসবাদ অর্থায়নের জন্য কোটি কোটি টাকা রয়েছে।
তবে আফগানিস্তানে অঞ্চল দখলে আইএস-কে কখনো সফল হয়নি। মসজিদ, স্কুল, বিয়ে অনুষ্ঠানে বেসামরিক নাগরিকদের হামলাই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। আফগানিস্তানে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নৃশংস হামলার জন্য সুপরিচিত আইএস-কে। শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রায়ই তাদের হামলার শিকার হয়।
২০১৫ সালের দিকে আইএস-কের প্রতিষ্ঠাতা সাঈদসহ মূল নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় প্রাণ হারান। তা সত্ত্বেও আফগানিস্তানে আইএস-কের বিনাশ হয়নি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানের কোনার ও নানগারহার প্রদেশে আইএস-কের দেড় হাজার থেকে দুই হাজারের বেশি যোদ্ধা রয়েছে। এ ছাড়া ছোট ছোট দলে তারা আফগানিস্তান জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১১৪
আপনার মতামত জানানঃ