আফগানিস্তানে ব্যহত হচ্ছে কোভিড পরীক্ষা ও টিকাকরণের কাজ। এ পরিস্থিতিতে দেশটিতে এখন যা অবস্থা তাতে সেখানে কোভিড সংক্রমণ ফের বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, আফগানিস্তান থেকে যেভাবে দলে দলে শরণার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছেন তাতে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে সংক্রমণ পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারে রীতিমতো সঙ্কটজনক। যার ফলে বিশ্বের সামগ্রিক করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
করোনা পরিস্থিতির বিপর্যয়ের আশঙ্কা
গত সপ্তাহে তালিবানদের ক্ষমতা দখলের পর নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা হাজার হাজার আফগান নাগরিককে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্সসহ ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো আফগানদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র তরফে আজ মঙ্গলবার আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, গত ১৫ আগস্ট কাবুল তালিবানের দখলে চলে যাওয়ার পর থেকে গত এক সপ্তাহে আফগানিস্তানে কোভিড পরীক্ষার হার একলাফে ৭৭ শতাংশ কমে গেছে।
এমন অবস্থায় দেশটির বর্তমান করোনা পরিস্থিতি জানার কোনও উপায় নেই। শরণার্থীর মধ্যে কারা কারা করোনায় আক্রান্ত জানা যাচ্ছে না। ফলে যে হারে আফগান শরণার্থীরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছেন আশ্রয় নিতে, তাতে গোটা বিশ্বেরই কোভিড পরিস্থিতি শীঘ্রই রীতিমতো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। পাশাপাশি আশ্রয় দেওয়া দেশগুলোতেও কোভিড টিকার সংকট তৈরি হতে পারে।
বিপদে আফগান স্বাস্থ্য খাত
হু-র পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার দফতর আরও জানিয়েছে, আফগানিস্তানের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে গত দু’দশক ধরে চিকিৎসার সরঞ্জাম সংগ্রহ করত হু। তারপর সেগুলি পাঠানো হত আফগানিস্তানে। এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল দেশটির স্বাস্থ্যখাত।
কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে যা চলছে কাবুল বিমানবন্দরে তাতে হু-র পাঠানো চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে বিমান অবতরণ করতে পারছে না। অস্ত্রোপচারের যন্ত্রাদি-সহ ৫০০ টন ওজনের নানা ধরনের চিকিৎসার সরঞ্জাম কাবুল বিমানবন্দরে আটকে রাখা হয়েছে।
অথচ সূত্র মতে, আর মাত্র এক সপ্তাহের মতো চিকিৎসার সরঞ্জাম মজুত রয়েছে আফগানিস্তানের হাসপাতালগুলোতে। সে ক্ষেত্রে তালিবান বিমান অবতরণে বাধা দিলে আফগানিস্তানের হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ।
হু-র এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রই এত দিন চালু ছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহে সেই পরিস্থিতি বদলেছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে নার্স, আয়ারা আর আসতে চাইছেন না। আসতে চাইছেন না মহিলা চিকিৎসকও।
এমনকি, মহিলা রোগীরাও হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার চেয়ে বাড়ির ভিতরেই রোগযন্ত্রণা ভোগ করা শ্রেয় মনে করছেন তীব্র আতঙ্কে।
কোন দেশে কত শরণার্থী?
আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তালিবানদের ক্ষমতা দখলের পর প্রথম সপ্তাহে ২৮ হাজার লোককে কাবুল থেকে সরানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন বিদেশি নাগরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা আফগানরা।
সংবাদ মাধ্যগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে কাবুল থেকে উদ্ধার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ধারকৃতদের একটি বড় অংশকে তৃতীয় কোনো দেশে প্রাথিমকভাবে রাখা হয়েছে। তাছাড়া জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য উদ্ধারকৃতদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে এসেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমান ঘাঁটিটি রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। আর তাই কাবুলে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তালিবানদের ক্ষমতা দখলের পর প্রথম এক সপ্তাহে ১৯ হাজার পাঁচশ জনকে কাবুল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার পাঁচশ জন মার্কিন নাগরিক। আর বাকিরা সাধারণ আফগান নাগরিক যাদের অনেকেই মার্কিন বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন।
কাতারে কী পরিমাণ শরণার্থীকে রাখা হয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও দেশটিতে অন্তত সাত থেকে আট হাজার শরণার্থী রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায় শত শত নারী পুরুষ সেখানে অস্থায়ী তাবুঁতে অবস্থান করছেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কাতারে অবস্থানরত এ শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে আরো বেশ কিছু দেশ আফগান শরণার্থীদের প্রাথমিকভাবে জায়গা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তথ্য অনুযায়ী আলবেনিয়া, ক্যানাডা, কোস্টারিকা, চিলি, কসভো, উত্তর মেসিডোনিয়া, উগান্ডা ও রুয়ান্ডাসহ মোট ১৩টি দেশ প্রাথমিকভাবে আফগান শরণার্থীদের জায়গা দেবে।
এদিকে বাহরাইন, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইটালি, কাজাখস্তান, কুয়েত, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশ আফগান শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার ট্রানজিট পথ হিসেবে কাজ করবে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরো বেশ কিছু দেশ আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। ২০ হাজার আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাজ্য। এ পরিকল্পনায় প্রাধান্য পাবে নারী, শিশু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।
দশ হাজার আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। জার্মান সেনাসদস্যরা কাবুল থেকে ইতিমধ্যে নিজ দেশের নাগরিকসহ দুই হাজার জনকে সরিয়ে নিয়েছে। তবে চ্যান্সেলর ম্যার্কেল শরণার্থীদেরকে আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় প্রদানের উপর জোর দিয়েছেন বলে জানিয়েছে দ্যা গার্ডিয়ান।
ইতিমধ্যে পাঁচশরও বেশি লোককে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়েছে ফ্রান্স। এদের বেশিরভাগই আফগান নাগরিক বলে জানা গেছে। তবে নতুন করে শরণার্থীর বিষয়ে অনেক সতর্ক প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ।
তিনি বলেন, ‘‘অবৈধ অভিবাসন থেকে ইউরোপের নিজেকে রক্ষা করতে হবে। বেশি মাত্রায় ঝুঁকিতে থাকা আফগান নাগরিকদের রক্ষায় ফ্রান্স এগিয়ে আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, ইউরোপের একার পক্ষে আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব নয়।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগান পরিস্থিতি বৈশ্বিক করোনা সংক্রমণের গ্রাফে বড়সড় পরিবর্তন আনতে চলেছে। যে সকল দেশ আফগান নাগরিকদের আশ্রয় দিচ্ছে, তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে বিপদ, অনেকটা যেন খাল কেটে কুমির আনা। এমনিতেই করোনায় নাস্তানাবুদ বিশ্বের তাবড়-তাবড় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এমন অবস্থায় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া দেশের জন্য করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে আফগান পরিস্থিতি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯৫১
আপনার মতামত জানানঃ