দেশে এখন ধর্ষণ মহামারি রূপ ধারণ করেছে। আন্দোলনের চাপে সম্প্রতি ধর্ষণ মামলায় সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত সম্প্রতি এমন কিছু নির্দেশনা দিয়েছে, যাতে করে ধর্ষকদের বিচার ও শাস্তির ভীতি আরও কমে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামীর সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে আয়োজনে আদালতের এমন উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখছেন না আইন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী কিংবা মামলা চলমান, এমন আসামীর সঙ্গে দুই পরিবারের সমঝোতায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে ধর্ষণের শিকার নারীকে। এ ধরণের কিছু প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত গড়াচ্ছে দেশের উচ্চ আদালতে। ধর্ষণের শিকার নারীর ‘কথিত সম্মতি’ নিয়ে হাইকোর্টে করা হচ্ছে আসামির জামিনের আবেদন। এসব আবেদনে হাইকোর্ট থেকে আসামির প্রস্তাব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কারাগার কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেওয়া হয়েছে উভয় পক্ষ রাজি থাকলে বিয়ের আয়োজন করতে।
আদালতে দেওয়া আসামির প্রতিশ্রুতি এবং সে অনুযায়ী হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বেশ কয়েকটি বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের শিকার নারীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করার প্রবণতা বাড়ছে। আইনজীবীদের প্রশ্ন, উচ্চ আদালতে মামলার সুরাহা না হতে এ ধরনের সমঝোতা কতটা আইনসম্মত।
অভিযুক্ত ধর্ষকের বিয়ে দেওয়ার ঘটনাগুলো আইন বহির্ভূত ও স্বেচ্ছাচার বলে উল্লেখ করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও নারী নেত্রীরা। তারা বলছেন, বিভিন্ন সময় ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীকে বিয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। নিপীড়কের সঙ্গে নিপীড়িত নারীকে বিয়ে দেওয়া এক ভয়াবহ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। এর বিচার হওয়া উচিত।
আইনবিদরা বলছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ’ বা ‘আপসযোগ্য ধর্ষণ’ বলে কিছু নেই। বাদি ও আসামী মীমাংসা করে ফেলতেই পারেন, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু যখন কোনো ঘটনায় আদালত যুক্ত হয়, তখন তার দায়িত্ব হলো আইনের শাসন কার্যকরী করা। যদি আইনের দুর্বলতার কারণে ধর্ষণ বহির্ভূত কোনো বিবাহযোগ্য ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সেই ঘটনাকে যেন ধর্ষণ হিসেবে দেখিয়ে মামলা না করা যায়, আদালত সে বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন। কিন্তু ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত আসামীকে সাজা দেয়ার পর আবার তাকে ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মুক্তি দেয়াটা নানা ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
মহানগর দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখলে মনে হয় যেন ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে সুবিধা পাইয়ে দেয়াটাই ছিল আদালতের লক্ষ্য। কিন্তু ভিকটিমকে সুবিধা দেয়া নয়, আদালতের দায়িত্ব হলো তাকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেয়া। কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তার জন্য নির্ধারিত শাস্তি অপরাধীকে পেতে হবে। আইনের এই সাধারণ নিয়মের বরখেলাফ হতে পারে না। এটা খারাপ নজির সৃষ্টি করবে। ধর্ষণের পর আদালতে মীমাংসা সম্ভব, এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পেলে ধর্ষণ আরো বেড়ে যেতে পারে।
মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরীন মুন্নী বলেন, আদালতের আদেশ নিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একজন ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর বিয়ে হবে, এটা কোনো সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না। এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। কারণ ধর্ষণ এমন একটা জঘন্যতম অপরাধ, যা আপসযোগ্য নয়। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত আপসের বিষয়ে কোনো আদেশ দিতে পারেন না। এসব ঘটনায় বলা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট নারী ও পুরুষ আপসে বিয়েতে রাজি হচ্ছেন। এই কথিত সম্মতিকে সাদা চোখে দেখা যাবে না। এটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন যে কতজন নারী স্বেচ্ছায় বিয়েতে রাজি হচ্ছেন। একজন নারী সত্য বলতে পারছেন কি না কিংবা কারো চাপে বিয়ে মেনে নিচ্ছেন কি না, তা পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
আগে এ ধরনের বিয়ে পড়ানো হতো রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগে। কখনো কখনো থানা-পুলিশও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। থানায় বিয়ের এক ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেছিলেন, ‘ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে দেওয়া জঘন্য অপরাধ। ধর্ষক আক্রমণকারী, যে কিনা নারীকে তার অমতে অপমানিত করেছে। নারীর শরীর অপমানিত হয়েছে তা বলছি না। অসম্মতিতে সে অপরাধ সংঘটনের মধ্য দিয়ে তাকে অপমান করেছে। ধর্ষক সবসময়ই ফৌজদারি আসামি। তার সঙ্গে বিয়ে হয় কী করে, তাও আবার থানায়? যাদের ওপর আইনশৃঙ্গলা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেওয়া আছে, তাদের দ্বারা আইনের এমন লঙ্ঘনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। এধরনের বিয়ে কোনোভাবেই হতে পারে না। এধরনের ঘটনা যদি হতে থাকে, তাহলে ধর্ষণ উৎসাহিত হয়। এ ঘটনাগুলোর জন্যই ধর্ষণ বাড়ছে। কেননা, অপরাধীরা মনে করছে যদি কোনও নারীকে সে স্পর্শ করে, তাহলে সেই নারীর ‘সম্ভ্রম’ রক্ষায় তাকে বিয়ে করার সুযোগ এই সমাজ করে দেবে।’
ধর্ষণের অভিযোগের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামির বিয়ের ঘটনা প্রথমে নজরে আসে গত বছর। জানা যায়, ঝিনাইদহের লক্ষ্মীপুর গ্রামের আজিজ মৃধার ছেলে ইসলামের সঙ্গে একই গ্রামের কাশেম আলীর মেয়ে মালা বেগম প্রেমের সম্পর্ক থেকে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এরই মধ্যে মালা বেগম গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং অন্তান জন্ম দেন। এ অবস্থায় মালা বেগমের পরিবার ও স্থানীয় লোকজন বিয়ের জন্য চাপ দিলেও ইসলাম বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান। এ অবস্থায় ইসলামের বিরুদ্ধে মালার পরিবার ধর্ষণের মামলা করে। এ মামলায় আদালত ইসলামকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এই সাজার বিরুদ্ধে প্রথমে হাইকোর্ট, পরে আপিল বিভাগে আপিল করলেও সাজা বহাল থাকে। পরবর্তী সময়ে এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করেন তিনি। এই রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানির সময় আসামী ইসলাম বাদী মালাকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হন। সেই সঙ্গে মিলনকে নিজের ছেলে হিসেবেও মেনে নেন। এ অবস্থায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘটা করে বিয়ে হয় মালা ও ইসলামের। সেখানে ছেলে মিলনও উপস্থিত ছিলেন। এরপর পুরো ঘটনা বর্ণনা করে ইসলামের জামিন ও মুক্তির জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। গত বছর ৩১ জুলাই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগও আইনজীবীর শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে ইসলামের জামিন মঞ্জুর করে তাঁকে মুক্তির নির্দেশ দেন।
আদালতের নথি থেকে জানা যায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সীতানাথ খালকোর ছেলে দিলীপ খালকোর সঙ্গে তাঁর খালাতো বোনের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। এরই সূত্র ধরে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক হয় দিলীপের। এতে গর্ভবতী হয়ে পড়েন ওই নারী। দিলীপ বিয়ে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওই বছরের ২৫ অক্টোবর তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়। এ মামলায় ২০১২ সালের ১২ জুন এক রায়ে দিলীপকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। কারাবন্দি দিলীপ হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। গত ২২ অক্টোবর এ আবেদনের ওপর শুনানিকালে তাঁর আইনজীবী জানান, তাঁরা দুজন বিয়ে করতে সম্মত। জামিন পেলে তাঁদের মধ্যে বিয়ে হবে। এ অবস্থায় আদালত উভয় পক্ষ যদি সম্মত থাকে তবে কারা ফটকে বিয়ের আয়োজন করতে কারা তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন। এরপর সেখানে তাঁদের বিয়ে হয়।
বিয়ের শর্তে জামিন আবেদন এবং হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, দুই পরিবারের দিকে তাকিয়ে এবং ঘটনা বিশ্লেষণ করে হয়তো সবচেয়ে উপযোগী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রকৃতপক্ষে যদি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই থাকে, তবে বিয়ের মধ্য দিয়ে সেই অপরাধ মুছে যাবে না। তবে তিনি জানান, রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা হিসেবে এ বিষয়ে ঢালাওভাবে মন্তব্য করতে চান না। তাঁর মন্তব্যের কারণে কারো ক্ষতি হোক, সেটা তিনি চান না। তবে প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ নয় এমন ক্ষেত্রে বিয়ের ঘটনা ঘটলে তা সামাজিক ক্ষেত্রে ভালো বলে মনে করেন তিনি।
মিই/আরা/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ