দুদকেই দুর্নীতি; চলতি বছরের ১৪ মার্চ দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ তোলপাড় তুলেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। ‘দুদকে অনুসন্ধান বাণিজ্য’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সুয়োমটো রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের সেই রুলের জবাবে সংবাদটি পর্যালোচনাপূর্বক ব্যাখ্যা আদালতে দাখিলের জন্য ইনকিলাবে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যগুলোকে বিভ্রান্তিমূলক এবং বস্তুনিষ্ঠ নয় বলে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
হাইকোর্টের নির্দেশনা
দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিদায়ের আগে দুর্নীতির বহু রাঘব বোয়ালকে ছেড়ে দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।’
প্রতিবেদনে অভিযোগ করে বলা হয়, ‘তাদের দায়মুক্তি আড়াল করতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন কিছু নিরীহ ও দুর্বল ব্যক্তিকে। সব মিলিয়ে শেষ ৫ মাসে তিনি ২ শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি (দায়মুক্তি) দেন।’
প্রতিবেদন প্রকাশের দু’দিন পর ১৬ মার্চ প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের নজরে আনেন সংশ্লিষ্ট কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।
এরপর শুনানি নিয়ে সংবাদে প্রকাশিত তথ্যের বিষয়ে কমিশনের অবস্থান ব্যাখ্যাসহ ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর থেকে গত ১০ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক কতটি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, ফার্ম, ব্যক্তি, স্থাপনাকে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা আদালতে দাখিলের নির্দেশনা প্রদান করেন হাইকোর্ট।
দুদকের প্রতিবেদন
ওই নির্দেশনা মোতাবেক দুদক একটি তালিকা ও তিন পৃষ্ঠার একটি ব্যাখ্যা প্রতিবেদন আকারে হাইকোর্টে দাখিলের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করে।
দুদক পরিচালক আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদের সই করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা সঠিক নয়। সংবাদটি বাস্তবতা বিবর্জিত এবং সংবাদে উপস্থাপিত তথ্য বস্তুনিষ্ঠ নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন ওই সংবাদের বিষয়বস্তুর সঙ্গে একমত নয়।’
আরও বলা হয়, ‘সংবাদে যে ৫ মাস সময়কালের উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময়ে কমিশনের কার্যক্রম অন্যান্য সকল সময়ের মতোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক যথাযথ নিয়ম, আইন ও বিধিবিধান অনুসারে সম্পন্ন করা হয়েছে। এখানে আইন বা বিধির কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি।’
উল্লেখ্য, সিদ্ধান্তগুলো আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে কমিশনের সিদ্ধান্ত হিসেবেই গ্রহণ করা হয়েছে এবং সকল সিদ্ধান্ত আইনগতভাবেই গ্রহণ করা হয়েছে।’
দুদকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “সংবাদের প্রথম বাক্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘বিদায়ের আগে দুর্নীতির বহু রাঘব-বোয়ালকে ছেড়ে দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান’। এ কথাটি সত্য নয়।”
‘কারণ, কমিশনের চেয়ারম্যান বা কোনও কমিশনার এককভাবে কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি/ছেড়ে দিতে পারেন না।’
‘সংবাদের দ্বিতীয় প্যারায় একটি সূত্রের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘ইকবাল মাহমুদ বিদায় নেওয়ার আগে স্বীয় কৃতকর্মের অনেক দালিলিক প্রমাণই যথাসম্ভব নিশ্চিহ্ন করে যান। কিন্তু এ তথ্যটির কোনও সত্যতা কিংবা ভিত্তি নেই।’
এছাড়াও সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কথিত নথিভুক্তি কিংবা অনুসন্ধান সমাপ্তির নেপথ্যে রয়েছে কোটি কোটি টাকার লেনদেন। এ বিষয়ে দুদক বলছে, ‘এটি একটি মনগড়া, ঢালাও এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ। যে সসব অভিযোগ নথিভুক্তি/পরিসমাপ্তি হয়েছে, তা আইনসঙ্গতভাবেই করা হয়েছে।’
সংবাদে প্রকাশিত আরও কিছু অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদনে দুদক তাদের ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েছে, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ধারা ৫(১) অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন কমিশন মূলত তিনজন কমিশনারের সমন্বয় গঠিত একটি কমিশন। তিনজন কমিশনারের মধ্যে একজনকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়।’
‘উক্ত আইনের ধারা ১৪ ও ১৫ অনুযায়ী, কমিশন তার সিদ্ধান্ত কমিশনের সভায় অথবা নথির মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকেন। কমিশনের সকল সিদ্ধান্তই সর্বসম্মতিক্রমে কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়ে থাকে, এককভাবে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সুযোগ নেই।’
তাই ওই পাঁচ মাসে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যানের কর্মকাণ্ডে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি বলে জানিয়েছে দুদক। একইসঙ্গে দুদক দৈনিক ইনকিলাবের সংবাদ প্রতিবেদনটিতে প্রকাশিত তথ্যগুলোকে বিভ্রান্তমূলক, যা বস্তুনিষ্ঠ নয় বলে উল্লেখ করেছে।
হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ
এ বিষয়ে দুদক আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান গণমাধ্যমকে বলেন, কোর্ট খুললেই আমরা এ বিষয়ে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করবো। একইসঙ্গে পত্রিকার সংবাদ প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সে সম্পর্কে আমরা আদালতকে জানাবো। মূলত তাদের (দৈনিক ইনকিলাবের) তথ্যগুলো বিভ্রান্তিমূলক এবং হলুদ সাংবাদিকতা।
তিনি আরও বলেন, দুদকের কোনও চেয়ারম্যান বা কমিশনার একা কোনও কাজ (সিদ্ধান্ত) করতে পারেন না। দুদক বিধি অনুসারে সর্বসম্মতিক্রমে বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সব হয়ে থাকে।
তিনি বলেন দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ তার সময়কালে যা করেছেন, তা আইন মেনেই করেছেন বলে হাইকোর্টে দাখিলের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫১৩
আপনার মতামত জানানঃ