সাম্প্রতিক সময়ে তিউনিসিয়ার উপকূলে বেশ কয়েকটি নৌযানডুবির ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছেন অনেকে; যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। এরপরও থেমে নেই এ পথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা। গত সাত বছরে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা গেছেন; এখানেও অধিকাংশই এদেশের। তবু দেশে এই মানবপাচার রোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। সচেতন নয় কর্তৃপক্ষ; এমনকি যারা যাচ্ছেন, তাদের পরিবার পরিজনও এ বিষয়ে দায়িত্বশীল নয়। পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার মানুষ এ পথে যাচ্ছেন।
মৃত্যুও থামাতে পারছে না বাংলাদেশিদের
লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌযানডুবিতে কমপক্ষে ১৭ বাংলাদেশি অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার (২১ জুলাই) তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্টের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে। সংস্থাটি জানায়, দেশটির কোস্টগার্ড সদস্যরা সাগর থেকে ৩৮০ জনের বেশি আরোহীকে উদ্ধার করেছে।
২০১৪ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন৷ এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে এ সময়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন৷
লিবিয়ার উত্তর-পশ্চিম উপকূলের জুয়ারা থেকে সিরিয়া, মিসর, সুদান, মালি ও বাংলাদেশের অভিবাসীদের নিয়ে রওনা দেয় নৌযানটি। রেড ক্রিসেন্ট জানায়, এ ঘটনায় ১৭ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন।
৩৮০ জনের বেশি অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা লিবিয়ার জুয়ারা থেকে ইউরোপের পথে রওনা দিয়েছিলেন। তবে মৃত ও উদ্ধার হওয়াদের নাম জানায়নি সংস্থাটি।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ইউএনএইচসিআর জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন৷ এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে এ সময়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন৷
সংস্থাটি জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন তিউনিশিয়ার অধিবাসীরা।
সংস্থাটি জানায়, শুধু সমুদ্রপথ নয়, দুর্গম মরুপথ ও বনজঙ্গল পার হয়ে ইউরোপে যেতে গিয়ে অনেকে বন্দি হন, প্রাণও হারান। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন ইউরোপে।
এক দশকে আটক ৫৫ হাজার বাংলাদেশি
অবৈধভাবে প্রবেশ করা বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে না নিলে ভিসা বন্ধের হুমকি দিয়েছিল ইউরোপ৷ পরে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও ইইউ-র অভিবাসন বিষয়কমন্ত্রী ইউরোপ থেকে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত আনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন৷
পাশাপাশি ফেরত আসা মানুষগুলোর জীবন যেন থমকে না যায়, সেজন্য দেশে ফেরত আসার পর তাদের পুনরেকত্রীকরণের উদ্যোগও নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ আইওএম-এর সঙ্গে বাংলাদেশে সেই কাজটি এখন করছে ব্র্যাক৷
এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। তাদের সংখ্যা তিন হাজার ৩৩২ জন। এরপরই রয়েছেন তিউনিশিয়ানরা। তাদের সংখ্যা দুই হাজার ৯৬২ জন।
২০১৪ সালে অবৈধভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে যান দুই লাখ ২৫ হাজার ৪৫৫ মানুষ। তাদের মধ্যে মারা যান তিন হাজার ৫৩৮ জন।
২০১৫ সালে সর্বোচ্চ পাড়ি দেন ১০ লাখ ৩২ হাজার ৪০৮ জন, মারা যান তিন ৭৭১ জন। ২০১৬ সালে তিন লাখ ৭৩ হাজার ৬৫২ জন, মারা যান পাঁচ হাজার ৯৬ জন। ২০১৭ সালে এক লাখ ৮৫ হাজার ১৩৯ জন পাড়ি দেন, পথে মারা যান তিন হাজার ১৩৯ জন। ২০১৮ সালে পাড়ি দেন এক লাখ ৪১ হাজার ৪৭২ জন, মারা যান দুই হাজার ২৭০ জন।
গত এক দশকে এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় আটক হয়েছেন ৫৫ হাজার বাংলাদেশি। মানবপাচারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট এটি। ভূমধ্যসাগর দিয়েই ইউরোপে ঢুকতে হয়।
২০১৯ সালে এক লাখ ২৩ হাজার ৬৬৩ জন পাড়ি দেন, মারা যান এক হাজার ৩৩৫ জন। ২০২০ সালে ৯৬ হাজার ৩১ জন অবৈধ পথে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে পারলেও পথে মারা যান এক হাজার ৪০১ জন।
গত এক দশকে এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় আটক হয়েছেন ৫৫ হাজার বাংলাদেশি। মানবপাচারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট এটি। ভূমধ্যসাগর দিয়েই ইউরোপে ঢুকতে হয়।
গত সাত বছরে ২২ লাখ মানুষ অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
তিনি আরও বলেন, অনেকেই আবার অ্যাসাইলাম (আশ্রয়) চেয়েছেন। এ সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। দেড় থেকে দুই লাখ। যারা অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি দেন তাদের অধিকাংশের বয়স ৩১ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এদের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ৷ এরপর আছেন ৩৬ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা৷ তাদের সংখ্যা ২১ শতাংশ৷
মানবপাচার রোধের উপায়
তিন উপায়ে এমন মানবপাচার রোধ করা সম্ভবত। প্রথমত, এক্ষেত্রে যারা যাচ্ছেন বা তাদের পরিবারকে দায়িত্বশীল হতে হবে; তারা সচেতন না হন তত দিন পর্যন্ত কিন্তু মানবপাচার ঠেকান সম্ভব হবে না।
দ্বিতীয়ত, আইনের যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিত করত্র হবে। একটি দুর্ঘটনার পর দু-একটি অভিযান পরিচালনা করলেই চলবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সারাবছরই অভিযান পরিচালনা করতে হবে সমন্বিতভাবে। কারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে।
তৃতীয়ত, দেশীয় চক্রের সঙ্গে মানবপাচারে জড়িত আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিকভাবেই কঠোর ও জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ