হঠাৎ করেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়েছে। প্রথমে উত্তরপ্রদেশ; বিধানসভা নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিল এনেছেন। সেখানে দুইটির বেশি সন্তান হলে সরকারি সুযোগসুবিধা, চাকরি বন্ধ হয়ে যাবে। আসামে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেনা নিয়োগ করার কথা ঘোষণা করলেন।
আর এ জন্য এক হাজার ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেনা’ নামাতে চলেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। তবে আসামের সর্বত্র নয়; বরং নমনী আসাম, যেখানে মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বাস, সেখানেই এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। খোদ সোমবার বিধানসভায় এমন ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
এর আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যই রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কার্যত বিস্ফোরণের আকার ধারণ করেছে বলেও দাবি করেছিলেন হিমন্ত। তার সমাধান হিসেবে স্বেচ্ছায় নির্বীজকরণ এবং দুই সন্তান নীতি চালু করার কথাও শোনা গিয়েছিল তার মুখে।
সোমবার বিধানসভায় তিনি বলেন, ‘চর চপোরি এলাকায় ১ হাজার যুবককে নিয়ে গঠিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেনা নামানো হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করবেন তারা। এলাকাবাসীর হাতে গর্ভনিরোধক তুলে দেবেন।’
আশা কর্মীদেরও এই কাজে নামানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সূত্র মতে, মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেয়ার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আত্মসমীক্ষার পরামর্শ দিয়েছিলেন হিমন্ত। তাদের জন্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন।
গতকাল সোমবার তিনি বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আসামে হিন্দু জনসংখ্যা যদি ১০ শতাংশ বেড়ে থাকে, মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে ২৯ শতাংশ। সংখ্যায় কম বলেই হিন্দুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত। খোলামেলা বাড়ি, গাড়ি রয়েছে হিন্দুদের। তাদের ছেলেমেয়েরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হন।’
যদিও মুসলিম জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে বলে দাবি করলেও, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে দেখা যায়নি হিমন্তকে।
অসমীয়া প্রতিদিনের দিল্লির ব্যুরো চিফ আশিস গুপ্তের মতে, ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো কীভাবে তা করা হবে?
তিনি বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে সঞ্জয় গান্ধী জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন। তার কী ফল হয়েছিল আমরা সকলে দেখেছি। জন্মনিয়ন্ত্রণ জোর করে করা যায় না। মানুষের মধ্যে সচেতনতা এনে করতে হয়।
তার মতে, ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের সেনা কেন বলা হবে? তারা কীভাবে কাজ করছে, কী কাজ করছে, সেটা দেখার পর বোঝা যাবে, সেখানে জোরজবরদস্তি করা হচ্ছে কি না।
এর আগে ১২ জুলাই (রবিবার) বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের দিনে ২০২১-৩০ দশকের জন্য উত্তরপ্রদেশের নয়া জনসংখ্যা নীতি প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ দুই সন্তানের কথা বলেছে যোগী। পাশাবেশি দুই সন্তানের মধ্যে ব্যবধান বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছেন তিনি। যোগী জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০২৬ সালের মধ্যে প্রতি হাজারে ২.১ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজারে ১.৯ করাই নয়া নীতির লক্ষ্য।
এই নীতিতে বলে হয়েছে, দুইয়ের অধিক সন্তান হলে কোনও ব্যক্তি সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন না, কোনও সরকারি ভর্তুকি পাবেন না, স্থানীয় কোনও নির্বাচনেও লড়তে পারবেন না। সরকারি চাকরি করাকালীন তৃতীয় সন্তান জন্ম নিলে চাকরি খোয়াতে হবে। কোনও প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া হবে না।
এদিকে, ভারতের বিজেপিশাসিত উত্তর প্রদেশ সরকারের নয়া জনসংখ্যা নীতিকে মানবাধিকারের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসিম নোমানী।
তিনি বলেন, যাদের দুইয়ের বেশি সন্তান হবে তাদেরকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা সেই শিশুদের প্রতি অন্যায়।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির (২০২১-২০৩০) বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, যদি দু’য়ের অধিক সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয় এতে বাচ্চাদের অপরাধ কি? এই আইন কোনো ন্যায় সঙ্গত আইন নয় বরং এটা একটা ভুল পদক্ষেপ।
মূলত ভারতে বিতর্কিত ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের পর এ বছরের শুরু থেকেই মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ফন্দিফিকির শুরু করে মোদি সরকার।
ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল আরএসএসপ্রধান মোহন ভাগবত যেকোন মূল্যে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে চান। রাষ্ট্রীয় সেবকসংঘ কোনো রাখঢাক না রেখেই ভারতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য মুসলিমদের দায়ী করে সরকারকে তা নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে।
আরএসএসের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১৯৫১ থেকে ২০১১ সালে ভারতে মোট জনসংখ্যার ৯.৮ থেকে ১৮.২৩ শতাংশ ছিল মুসলিম।
কিন্তু জনগণনার হিসাব বলছে, ২০০১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে মুসলিমদের সংখ্যা ২৪.৬ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে তার আগের দশকে, অর্থাৎ ১৯৯১ সালের তুলনায় ২০০১-তে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ২৯.৫ শতাংশ। আগের দশকগুলোতে এই হার ৩০ শতাংশের বেশি।
কিন্তু ভারতে ১০ বছর অন্তর অন্তর যে জনগণনা হয়, তার পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ১০ বছরে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধাপে ধাপে কমে আসছে।
ভারতের ২০১১ সালের রাষ্ট্রীয় জনগণনায় ১২১.০৯ কোটি মানুষের মধ্যে হিন্দু ছিল ৯৬.৬৩ কোটি (৭৯.৮ শতাংশ) এবং মুসলিম ছিল ১৭.২২ কোটি (১৪.২ শতাংশ)।
দেশটিতে ১৯৫১-৬১ সালে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩২.৪ শতাংশ, ১৯৬১-৭১ সালে ৩০.৯ শতাংশ, ১৯৭১-৮১ সালে ৩০.৭ শতাংশ, ১৯৮১-৯১ সালে ৩২.৮ শতাংশ, ১৯৯১-২০০১ সালে ছিল ২৯.৫ শতাংশ, ২০০১-২০১১ সালে ছিল ২৪.৬ শতাংশ।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ