নগরবাসীর কাছে শহরের সিআরবির শিরীষ তলার এই জায়গাটি চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ হিসেবেই পরিচিত। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমলের সিআরবি ভবনকে ঘিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষের গাছপালা, পাশেই পিচঢালা আঁকাবাঁকা রাস্তা, ছোট বড় পাহাড়-টিলা আর নজরকাড়া বাংলো। কিন্তু উদ্বিগ্ন হবার মত ব্যাপার হলো, বড়সড় একটি হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করে সেই ‘ফুসফুস’ ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
অবিভক্ত ভারতের বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ের সদর দপ্তর সিআরবি ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে ১৮৯৫ সালে। শতবর্ষী বৃক্ষ ঘেরা পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ঘেরা এ এলাকাটি সকল বয়সী সাধারণ জনগণের প্রাণ খুলে মুক্ত বাতাসে হাঁটাহাঁটি কিংবা ঘুরতে আসার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’ অনুযায়ী খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাইবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো উদ্যানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয় এইরূপে উহার বৃক্ষরাজি নিধনকে উদ্যানটির শ্রেণি পরিবর্তনরূপে গণ্য করা হবে।
জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮’ এর ৩.১৭ ধারায় আবাসন, গৃহায়ন ও নগরায়ন (Accommodation, Housing and Urbanization) এ স্পষ্টভাবে বলা আছে, সারাদেশে খেলার মাঠ, পার্ক, বাগান, নার্সারি, উন্মুক্ত স্থান ও ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাসমূহ সংরক্ষণে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী চিন্তা করলেও দেখা যায় কোনোভাবেই বন্দরনগরীর ফুসফুস খ্যাত সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং ঐতিহ্য ধ্বংস করে হাসপাতাল নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই।
নগর পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে দেখা যায়, ২০১২ সালে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিআরবিকে সাজিয়ে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। রেলওয়ে সদর দপ্তর এবং এখানকার রেলওয়ে আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছিল।
সিআরবির পুরো এলাকাকে প্রকল্পের আওতায় না এনে লোকজন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত সাতরাস্তার মোড়কে ঘিরে ২৫ একর জমির উপর প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনার মধ্যে ছিল সিআরবির অভ্যন্তরে ছোট খালটিকে বাড়িয়ে কৃত্রিম লেক তৈরি, ফোয়ারা, কৃত্রিম ঝরনা, পাহাড়ে ওঠার জন্য সিঁড়ি নির্মাণ, এক পাহাড়ের সঙ্গে অপর পাহাড়ের সংযোগ তৈরির জন্য ফুট ওভারব্রিজ, লেকের ওপর কাঠের পাটাতনে বসার জায়গা, হাঁটাচলার জন্য দুই কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তার পাশে তাঁবুর আদলে বসার জায়গা সৃষ্টি করা।
এছাড়া পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা খাদে অ্যাম্ফিথিয়েটার নির্মাণ করে সেখানে একসঙ্গে চার হাজার মানুষ বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুবিধা তৈরির কথা ছিল। ওয়াকওয়ে, রুফওয়ে, লেক, ঝরনা, ফুড কর্নারসহ আরও কিছু নাগরিক সুবিধা রাখারও পরিকল্পনা ছিল।
সিআরবির শতবর্ষ পুরনো গাছগুলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্য বহন করে। এই গাছগুলো কেটে হাসপাতাল তৈরী করার সিদ্ধান্তকে বিশেষজ্ঞরা শহরের প্রাণ ধ্বংস হিসেবে দেখছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২১৪৬
আপনার মতামত জানানঃ