নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আলোচিত এ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ-এ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেম। এই অগ্নিকান্ডের পর একে একে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য অনিয়ম আর দুর্নীতির তথ্য। সস্তা শ্রমের জন্য এই প্রতিষ্ঠানে শিশু অনৈতিকভাবে শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো হতো নামমাত্র মজুরিতে। তবুও বকেয়া মজুরির জন্য সপ্তাহখানেক আগে রাস্তায় বিক্ষোভ করে কারখানার শ্রমিকেরা। এর পরপরই ভয়াবহ আগুনে শ্রমিকদের মৃত্যুটা তাই বেশ রহস্যজনক। পাশাপাশি বিশাল অঙ্কের ঋণে ডুবে আছে এই প্রতিষ্ঠানটি। সব মিলে এ যেন অনিয়ম আর দুর্নীতির ঠাকুরমার ঝুলি। কখনও ফুরাবার নয়।
বকেয়া বেতনের জন্য বিক্ষোভ করেছিলেন শ্রমিকেরা
মাত্র সপ্তাহখানেক আগে (১ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার) এই কারখানায় কর্মরত শিশু-কিশোর, শ্রমিক-জনতা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন। দুই মাস ধরে তাদের বেতন ও ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করছিল না মালিকপক্ষ। বাড়িভাড়া ও মুদিদোকানের বকেয়া পরিশোধ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তারা রাস্তায় নেমেছিলেন।
১ জুলাই বিক্ষোভের খবর পেয়ে কাঁচপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও ভুলতা ফাঁড়ি পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ এনেছিল। গলা উঁচু করে জানিয়ে গিয়েছিল, ‘মালিকপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। ৫ জুলাই শ্রমিকদের দুই মাসের বকেয়া ওভারটাইমের টাকা দিয়ে দেয়া হবে। বাকিটা ঈদের আগে পরিশোধ করে দেওয়া হবে। কোম্পানির অ্যাডমিন ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিনও সংবাদমাধ্যমকে একই কথা বলেছিলেন।
বলা বাহুল্য, কেউ কথা রাখেনি। এদিকে সপ্তাহ না ঘুরতেই তারা শিকার হলেন কারখানার রহস্যময় আগুনের। মালিক বলেছেন, আগুন লাগতেই পারে। কী কঠিন পরিহাস!
কারখানায় বেশিরভাগই ছিল শিশুশ্রমিক
সেজান জুস কারখানায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করত। তৈরি করা হতো জুস, ক্যান্ডি, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাইসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য। রূপগঞ্জে হাশেম ফুড লিমিটেডের এই সেজান জুস কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিকই ছিল শিশু। সূত্র মতে, এসব শিশু শ্রমিকদের অল্প বেতনে খাটাতো প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি কয়েক মাসের বেতনও বকেয়া ছিল তাদের।
গত বৃহস্পতিবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের অধিকাংশই শিশু বলে জানিয়েছেন বেঁচে ফেরা শ্রমিকরা। কারখানাটির শ্রমিক রাজিব বলেন, এখানকার বেশিরভাগ শ্রমিক শিশু। তাদের মধ্যে যারা মেয়ে তাদের বয়স ১২ বছর থেকে শুরু আর ছেলেদের বয়স ১৪ থেকে শুরু।
দরিদ্র পরিবারের শিশুরা এখানে তিন হাজার থেকে শুরু করে ছয় হাজার টাকা বেতনে কাজ করে। যে ভবনে আগুন লেগেছে সেই ভবনের পাশে একই কোম্পানির আরেকটি ভবনের দায়িত্বশীল একজন বলেন, মূলত কম বেতনের কারণেই মালিক শিশুদের নিয়োগ দিতেন।
সূত্র মতে, দুজন ঠিকাদারের মাধ্যমে শিশুদের ভোলা ও কিশোরগঞ্জ থেকে নিয়ে আসা হতো। এই শিশু শ্রমিকদের বেতন ধরা হতো খুবই কম। সাড়ে ছয় হাজার টাকা বেতনে তাদের চাকরি শুরু হতো। ছয় মাস পরে যাদের স্থায়ী (পার্মানেন্ট) করা হতো তাদের দেওয়া হতো ১০ হাজার ৫০০ টাকা। শুরুর দিকে হাতের কাজ করলেও চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর বিভিন্ন পণ্য তৈরির মেশিনের সহকারী হিসেবে কাজ করতো এই শিশুরা।
ভোলা ও কিশোরগঞ্জ থেকে যেসব শিশু নিয়ে আসা হতো তাদের একটি বড় অংশকে কারখানার পাশে কোয়ার্টারে রাখা হতো। সেখানে থাকা ও খাওয়া বাবদ এক হাজার টাকা প্রতি মাসে প্রত্যেক শিশুর কাছ থেকে নেয়া হতো। দুজন ঠিকাদারের মধ্যে ভোলা থেকে যে শিশুদের আনা হতো তাদের তত্ত্বাবধান করতেন মোতালিব। আর কিশোরগঞ্জ থেকে শিশুদের আনা ও তত্ত্বাবধান করতেন রাজ্জাক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর প্রাণভয়ে এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে ছুটছিল শিশু শ্রমিকরা।
ঋণে ডুবে আছে সজীব গ্রুপ
সজীব গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সজীব করপোরেশন, হাশেম ফুডস লিমিটেড, হাশেম অটো রাইস মিলস, সজীব ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, হাসেম অ্যাগ্রো প্রসেসিং লিমিটেড, তাকফুল ইসলামী বিমা লিমিটেড, হাসেম ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেড, সজীব হোমস লিমিটেড, মারস ইন্টারন্যাশনাল, সজীব লজিস্টিকস ও স্যাভি ফুডস।
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, এক দশক আগেও গ্রুপটির আকার ছিল ৫০০ কোটি টাকার মতো। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত গ্রুপটির ১১ প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।
বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সজীব করপোরেশনের নামে ঋণ আছে ৩৬০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় রাজধানীর ফার্মগেটে। আর হাসেম রাইস মিলস লিমিটেডের নামে ব্যাংকঋণ আছে ৩৩৮ কোটি টাকা। চাল উৎপাদনের এ মিলের অবস্থান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায়।
এছাড়া হাসেম ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেডের নামে ২০১ কোটি, সজীব লজিস্টিকস লিমিটেডের নামে ৩৮ কোটি, সজীব হোমস লিমিটেডের নামে ২৯ কোটি, হাসেম অ্যাগ্রো প্রসেসিং লিমিটেডের নামে ২০ কোটি, হাসেম অটো রাইস মিলের নামে ৮ কোটি, স্যাভি ফুডস লিমিটেডের নামে ৩ কোটি এবং মারস ইন্টারন্যাশনালের নামে ২১ লাখ টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে।
মালিক সহ ক্ষমতায় থাকা সবাই গ্রেপ্তার
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুনের ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন অর্ধশতাধিক এবং আহত হয়েছেন আরও। এই ঘটনায় কারখানাটির মালিক আবুল হাসেম ও তার ছেলেরা সহ মোট আটজনকে চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খানমের আদালত তাদের এ
রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডপ্রাপ্তরা হলেন- আবুল হাসেম, তার চার ছেলে হাসিব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম ও তানজীম ইব্রাহীম এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, হাসেম ফুড লিমিটেডের ডিজিএম মামুনুর রশিদ ও এডমিন প্রধান সালাউদ্দিন। নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান শনিবার (১০ জুলাই) বিকেলে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ভবনটি নির্মাণে ত্রুটি ছিলো। ভবনে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। আমরা মনে করি এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা এ ঘটনায় সরাসরি হত্যা মামলা দায়ের করেছি। ইতোমধ্যে মালিক পক্ষ ও ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাকিদের মধ্যে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানের সিও, ডিরেক্টর, কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিকিউরিটি ইনচার্জ। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরও কেউ থাকলে তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
এদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রূপগঞ্জ থানার পরিদর্শক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘হত্যা ও হত্যার অভিযোগে ৩০২, ৩২৬, ৩২৫, ৩২৩, ৩২৪, ৩০৭ ধারায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আবুল হাসেমসহ আটজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ মামলায় অজ্ঞাত আসামিও করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, গ্রেফতারদের ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত আসামিদের জামিন না মঞ্জুর করে প্রত্যেককে চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।’
রুপগঞ্জ কারখানাটির আগুন নেভানোর জন্য ডেমরা, কাঞ্চনসহ ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট কাজ করে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৯ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এ সময়ের মধ্যে ঝরে গেছে ৫২ প্রাণ। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন।
অন্যদিকে মহাপরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে জেনেছি যে ভবনটির ছাদে উঠার সিঁড়ির আগে কলপাসিবল গেট ও নেটের দুটি গেট বন্ধ ছিল। এই নেটের গেট থাকার কারণে ভেতরের শ্রমিকরা ছাদে উঠতে পারেনি। তারা ভবনের ভেতরে আটকা পড়ে। যে কারণে আগুনের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। ‘
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রধান উপ-মহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া বলেন, ‘জেলা প্রশাসন থেকে ৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস থেকে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন হয়েছে। আমাদের দপ্তর থেকে কারখানার সেফটির বিষয়টি তদন্ত করছি। ডিআইজি সেফটিকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ‘
সুষ্ঠু তদন্ত শেষে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতকরণ এবং বাকি কারখানাগুলোতে সাবধানতা অবলম্বনের বিষয়ে গুরুত্বর পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে অপরিকল্পিতভাবে কারখানা নির্মাণের বিরুদ্ধেও সরকারি কর্মকর্তাদের জোরদার অবস্থান দরকারি হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৯২৮
আপনার মতামত জানানঃ