সম্পাদকীয় বোর্ড : ‘মজলুম জননেতা’ খেতাব পাওয়া মওলানা ভাসানী ছিলেন এ দেশের শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তসহ নিপীড়িত জাতি ও জনগণের পরম বন্ধু। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামী রাজনীতিবিদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১৭ নভেম্বর ২০২০। সাধারণ মানুষের এই নেতা ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আজ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি স্মরণ করবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানঘড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সিরাজগঞ্জে জন্ম হলেও তিনি জীবনের সিংহভাগই কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। কৈশোরেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন তিনি তৎকালীন বাংলা-আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান ভাসানী। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি।
রাজনীতির পাশাপাশি মওলানা ভাসানী সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। লাইনপ্রথা উচ্ছেদ, জমিদারদের নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনসহ সারাজীবনই তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। তার উদ্যোগে কৃষকদের নিয়ে ১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লংমার্চে নেতৃত্ব দেন তিনি। তিনি তার কৈশোর-যৌবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি তৎকালীন বাংলা-আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে গঠিত প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীর সভাপতিও ছিলেন তিনি।
‘দ্য রেড মওলানা’ নামে খ্যাতি পেয়েছিলেন ভাসানী, শোষণ উচ্ছেদের লড়াইয়ে সমর্থন ও সক্রিয় আন্দোলনের জন্য। মোলানা তার নাম, পরিচয় ও চিন্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও বিপুল জনগণের মতোই তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িক চেতনা ও কর্মকাণ্ডের ঊর্ধ্বে। ব্রিটিশসৃষ্ট সাম্প্রদায়িক উগ্রতা নয় বরং ধর্ম ছিল তার কাছে জনগণের নিকটবর্তী হওয়া ও জনসেবার পথ।
সমাজ সংগঠকরা মনে করেন, মওলানার শিক্ষা আমাদের স্মরণ ও অনুসরণ করতে হবে। মওলানার কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল, সেগুলোর সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াটাও আমাদের কর্তব্য। তবে মওলানার গোটা জীবন এবং মৃত্যুর পরও তার কথা ও কাজ জনগণের স্বার্থের পক্ষে লড়াই করে চলেছে। কেউ যদি মওলানাকে এ অঞ্চলের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের বন্ধু মনে করেন, তবে মওলানার বিরোধীদের জনগণের শত্রু মানতে হবে। জনগণের শত্রুদের মুখে সব সময়ই মিঠা বুলি থাকে। এদের চিহ্নিত করার অনেকগুলো মানদণ্ড রয়েছে। মওলানা ভাসানী এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। যারা মওলানাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে না তারা আসলে জনগণের স্বার্থেরই বিরোধিতা করে এবং শেষ পর্যন্ত তারা গণশত্রুদেরই সেবা করে।
জাতীয় সংকটে জনগণের পাশে থেকে মওলানা ভাসানী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। সবসময় ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন তিনি। ক্ষমতার কাছে থাকলেও ক্ষমতার মোহ তাকে কখনও আবিষ্ট করেনি। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন নির্মোহ, অনাড়ম্বর ও অত্যন্ত সাদাসিধে। তার সাধারণ জীবনযাপন এ দেশ ও জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রতিফলন।
এ অঞ্চলের জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে মওলানা সুদীর্ঘকাল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনীতির প্রতীক হিসাবে বিরাজ করবেন। শোষিত, বঞ্চিত মানুষ তাকে মনে রেখেছে, যাদের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এক মহৎ ও কর্মমুখর জীবন নিয়ে মওলানা ভাসানী এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তিনি যে রাজনৈতিক দর্শন রেখে গেছেন, যে জীবন ও কর্ম আমাদের দেখিয়েছেন, তা চিরঞ্জীব। মওলানা ভাসানীর জীবন ও রাজনীতি আজও আমাদের পথ দেখাতে পারে। তার রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে গেলে আজও শোষিত-বঞ্চিত মানুষ আশার আলো খুঁজে পাবে। আমাদের রাজনীতিকরা কি মওলানা ভাসানীর পথে ঠিকঠাক অনুসরণ করছেন, এমন প্রশ্ন আজ অনেকেই তুলছে।
মিই/আরা/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ