করোনায় কাঁপছে গোটা দেশ। দৈনিক শনাক্ত দশ হাজার ছুঁইছুঁই। মৃত্যু গত প্রায় এক সপ্তাহ যাবত প্রতদিন একশোর কোঠা পার হচ্ছে। দেশের পশ্চিমাংশের বর্ডার ঘেঁষা জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার এখন ৩০-৬৫ শতাংশ। জিনোম সিকোয়েন্স ডাটা অনুযায়ী এই সংক্রমণের ৮৫ ভাগই হচ্ছে ভারতের অতিসংক্রামক ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ দিয়ে। এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন সীমান্ত অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়িছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের মধ্যাঞ্চলে। এটা এখন নিশ্চিত যে দেশে মহামারির তৃতীয় ঢেউটি হতে যাচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে।
তাই এখন সময়ের সবথেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে কোভিড টিকাগুলো এই ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে কতটুকু কার্যকর। দেশে যারা ইতিমধ্যেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা (কোভিশিল্ড) নিয়েছেন, তারা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে কতটা সুরক্ষিত, এই নিয়েই এখন প্রশ্ন জনগণের মধ্যে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা
যুক্তরাজ্যেও সাম্প্রতিক সংক্রমণের ৯০ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। দেশের ৬২ শতাংশ মানুষকে কোভিড টিকার অন্তত একটি ডোজ দেওয়া হয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি হচ্ছে অক্সফোর্ড টিকা। এই টিকার ওপর নির্ভর করেই আগামী ১৭ জুলাই লকডাউন সম্পূর্ণরূপে শিথিল করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড অতিসম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে এপ্রিল থেকে জুনে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ১৪ হাজার রোগীর ওপর। এই গবেষণার একটি প্রি-প্রিন্ট তারা তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ১৪ জুন। ফলাফলে দেখা যায় যারা অক্সফোর্ড টিকার দুটো ডোজ নিয়েছেন, তাদের ভেতরে ৯২ শতাংশ কোনো ধরনের মারাত্মক কোভিডে আক্রান্ত হয়নি বা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। আর যারা টিকাটির একটি ডোজ নিয়েছেন, তাদের ৭১ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
একই ধরনের ফলাফল দেখা গেছে ফাইজারের টিকার ক্ষেত্রেও। যারা ফাইজারের দুটো ডোজ টিকা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ মারাত্মক কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আর যারা অন্তত একটি ডোজ নিয়েছিলেন, তাদের ৯৪ শতাংশ মারাত্মক কোভিড থেকে মুক্ত ছিলেন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ১৪ হাজার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের মধ্যে যে ১৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের কেউই মৃত্যুবরণ করেননি।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১৫ জুনের প্রেস রিলিজের দাবি অনুযায়ী, তাদের টিকার দুটো ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে মৃত্যু ঠেকায় শতভাগ। উপরের সংখ্যা থেকে হয়তো তা দাবি করা যেতেই পারে। তবে, পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের ভ্যাষ্যমতে, ভবিষ্যতে এই মৃত্যু প্রতিরোধে ‘শতভাগ’ সংখ্যাটির সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও হতে পারে।
তবে এই ‘রিয়েল লাইফ এভিডেন্স’ থেকে এটা নিশ্চিত যে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং ফাইজার টিকার দুইটি ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে হওয়া মারাত্মক কোভিড থেকে আমাদের সুরক্ষা দেয় গড়ে ৯৪ শতাংশ। আর যারা যেকোনো একটি টিকার একটি ডোজ নিয়েছেন, তারা মারাত্মক কোভিড থেকে রক্ষা পাবেন ৭৫ শতাংশ।
এদিকে, টিকার দুটো ডোজ নেয়ার পরও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় প্রায় ২০-৪০ শতাংশ।
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের ২৪ মে প্রকাশিত মেড-আর্কাইভের একটি প্রি-প্রিন্টের ফলাফল থেকে দেখা যায়, অক্সফোর্ড বা ফাইজার টিকার একটি ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সিম্পটমেটিক কোভিড প্রতিরোধ করে মাত্র ৩৩ শতাংশ। তবে, অক্সফোর্ড এবং ফাইজারের দুই ডোজ টিকা এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয় যথাক্রমে ৬০ ও ৮১ শতাংশ।
এ থেকে বলা যায়, পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের চালানো দুটো পৃথক ‘রিয়েল-লাইফ এভিডেন্স’ থেকে এটা পরিষ্কার যে টিকা নেয়ার পর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হলেও তা থেকে মারাত্মক কোভিড বা মৃত্যু কমে যায় প্রায় শূন্যের কোঠায়। আর যারা টিকার একটি ডোজ পেয়েছেন, তারা মারাত্মক কোভিড থেকে ৭৫ শতাংশ মুক্ত থাকতে পারেন।
টিকা দেয়া হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষকে
এক্ষেত্রে বলা যায়, বাংলাদেশ যারা টিকা নেওয়ার পরও এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময় আক্রান্ত হচ্ছেন বা হবেন, তাদের ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। কেননা, তাদের ১০০ জনের মধ্যে ৯৪ জনই সামান্য ভুগে কোভিড থেকে সেরে উঠবেন।
কোভিড মহামারিতে জীবন রক্ষায় টিকা অপরিহার্য। এটা আর এখন কোনো তত্ত্বগত বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা নয়। এটা এখন বাস্তবতা। এই বাস্তবতা প্রমাণিত হয়েছে অক্সফোর্ড ও ফাইজার টিকার ক্ষেত্রে। তবে, একই ফল হয়তো দেখা যাবে চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক টিকার ক্ষেত্রেও।
কারণ, সব টিকার মূলনীতি একই, দেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকে প্রশিক্ষিত করা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যতগুলো টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সবগুলোই কার্যকর টিকা।
তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশে গণটিকা কার্যক্রমের সূচনা ভালো হলেও এখন পর্যন্ত দেশের মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ মানুষকে টিকার অন্তত একটি ডোজ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যেখানে এই সংখ্যাটি ভারতের ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ এবং নেপালের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ।
এই সংখ্যাটি যত দিন পর্যন্ত ৬০-৭০ শতাংশে না উন্নীত করা যাবে, ততদিন পর্যন্ত টিকার সুফল পাওয়া যাবে না। মহামারি থেকে বের হয়ে আসার এখন একটিই রাস্তা। আর তা হলো দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোভিড টিকার আওতায় আনা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ