দেশের মধ্যে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বন্যা হতে পারে। এতে উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের ২০টি জেলা আক্রান্ত হতে পারে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের(এফএফডব্লিউসি) প্রতিবেদনে এ আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, মধ্যাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা অববাহিকার লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, নওগাঁ ও নাটোর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরও জানায়, উজান থেকে দেশে প্রবেশ করা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা অববাহিকায় পানি দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। এতে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে দেশের অন্তত ২০টি জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হতে পারে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের নিচু এলাকায় বন্যা দেখা দিতে পারে। তবে এই বন্যা গত বছরের মতো এত দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা নেই।
তবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গঙ্গা নদীর অববাহিকার জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং কতিপয় স্থানে বিপদসীমা অতিক্রম করে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে বলে পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূইয়া বলেন, সাধারণত জুলাইয়ের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চলে একটি স্বাভাবিক বন্যা হয়। এবারও সেটি আসতে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটি এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হবে না। তবে বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করবে বন্যার স্থায়িত্ব কতদিন হবে।
আরিফুজ্জামান ভূইয়া বলেন, জুন মাসে বাংলাদেশ ও উজানের অববাহিকার অনেক স্থানে বৃষ্টিপাতসহ কতিপয় স্থানে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়েছে। এর ফলে দেশের প্রধান নদীগুলোর পানি বাড়লেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আবহাওয়ার সাম্প্রতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে উজানের অববাহিকার অনেক স্থানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি সামগ্রিকভাবে বাড়তে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর জন্য আগামী সাত দিনের অববাহিকাভিত্তিক ধারণাগত পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও ধরলা নদীর পানির সমতল বৃষ্টিপাত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে বিধায় বিশেষ সময়ে পানি দ্রুত বেড়ে যেতে পারে। এতে লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে। রাজশাহী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা গঙ্গা (পদ্মা) নদীতে এবার এখন পর্যন্ত বন্যার আশঙ্কা দেখছে না এফএফডব্লিউসি।
তবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি নেমে এসে পদ্মায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এতে রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে এসে গঙ্গা ও যমুনা মিলে একত্রে পদ্মা নামে প্রবাহিত হয়েছে।
এফএফডব্লিউসির তথ্য অনুযায়ী, আগামী এক সপ্তাহে মেঘনা অববাহিকার উপরের অংশ বা সুরমা-কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, যদুকাটা, সোমেশ্বরী, ভূগাই-কংস, মনু ও খোয়াই নদী কোথাও কোথাও বিশেষ সময়ে বিপৎসীমা পার করতে পারে। এ কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বন্যা দেখা দিতে পারে। আর হালদা, মাতামুহুরী, সাঙ্গুসহ পার্বত্য অববাহিকায় মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় ভারি বর্ষণের কারণে ভূমিধসের আশঙ্কা আছে।
মূলত অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল আর উজান থেকে আসা পানির কারণে বাংলাদেশে বন্যা হয়ে থাকে। গত বছর ২৭ জুন থেকে প্রায় দেড় মাস স্থায়ী বন্যার কবলে পড়েছিল দেশ। সেই হিসাবে এবার এখন পর্যন্ত নিরাপদ আছে দেশ। গত বছর বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড় নিসর্গের কারণে অতিবৃষ্টি থেকে এই বন্যা তৈরি হয়েছিল। এবারও অবশ্য উভয় সাগর থেকে দুটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এর থেকে বেশকিছু বৃষ্টিও হয়। তবে তা বন্যায় রূপ নেয়নি।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত দেশের চারটি অববাহিকায় বন্যা হয়ে থাকে। এগুলো হলো ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, মেঘনা ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকা। এখন যে বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, সেটা প্রথম তিনটিতে ঘটার আশঙ্কা আছে। সাধারণত বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বন্যা জড়িত। বর্তমানে বিপদসীমার অনেক নিচে অবস্থান করছে নদীগুলো। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায়ই ১০ দিনে ১৫৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে। এর কারণে ৬ জুলাই উত্তরাঞ্চলে বন্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, বন্যা থেকে মানুষকে রক্ষায় বর্তমানে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রমে সরকারের ভালো প্রস্তুতি আছে। কিন্তু দরকার দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন। বন্যার পরপরই নদীভাঙন দেখা যায়। এতে অনেকে সর্বস্বান্ত হন। বন্যার সময়ে অনেকে এসে বাঁধের উপর উঠেন। বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় বা পুনর্বাসন না করায় তারা আর বাঁধ থেকে যান না। এতে বাঁধের ক্ষতি হয়। তাই সরকারকে পুনর্বাসনে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি করোনার মধ্যে বন্যার্তরা যাতে সংক্রমিত না হয়, এ ব্যাপারে মাঠপ্রশাসনকে সতর্ক ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১১
আপনার মতামত জানানঃ