চীনের উত্তর-পূর্বে হারবিনে জীবাশ্ম হিসেবে সংরক্ষিত অবস্থায় যে খুলিটি পাওয়া গেছে তা কমপক্ষে এক লাখ ৪০ হাজার বছরের পুরানো মানুষের একটি নতুন প্রজাতির। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের প্রজাতিকে ‘ড্রাগন মানব’ নামকরণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
শুক্রবার এই ঘোষণা দিয়ে এর সঙ্গে জড়িত গবেষক দলের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, নতুন এই আবিষ্কার আমাদের প্রজাতি ‘হোমো সেপিয়েন্সের’ উদ্ভব কীভাবে এবং কোথা থেকে হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বর্তমান ধারণা বদলে দিতে পারে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুঁজে পাওয়া খুলিটি একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের, যার একটি বড় মস্তিষ্ক ছিল; ছিল বিশাল আকারের ভ্রুর খাঁজ, গভীর কোটর বিশিষ্ট চোখ এবং কন্দ আকৃতির নাক।
এই খুলিটি চীনের উত্তর-পূর্বে হারবিনে ১৯৩৩ সালে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ৮৫ বছর ধরে এটি লুকানো ছিল।
বিবিসি জানিয়েছে, জাপানের দখলে থাকার সময় হারবিনে একটি নির্মাণকাজ চলাকালে একজন শ্রমিক খুলিটি খুঁজে পান। এর গুরুত্ব থাকতে পারে- এই বিবেচনায় চীনা শ্রমিকটি জাপানিদের হাত থেকে সেটা রক্ষায় নিজের বাড়ির কূয়ায় লুকিয়ে রাখেন। পরে ওই শ্রমিকের পারিবারিক সূত্রেই সেটা চীনের বিজ্ঞানীদের হাতে আসে।
গবেষকরা নতুন প্রজাতির নাম দিয়েছেন ‘হোমো লোংগি’ এবং ডাক নাম দেওয়া হয়েছে ‘ড্রাগন ম্যান’। চীনের উত্তর-পূর্বে বয়ে চলা ড্রাগন নদীর নামানুসারেই এই নামকরণ করেছেন তারা। সেখানেই খুলিটি পাওয়া গেছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, হোমো লোংগির সঙ্গে নিয়ানডারথালদের সম্পর্ক নেই এবং লোংগিরা বিলুপ্ত প্রজাতি। তবে এরাই সম্ভবত হোমো পেয়েন্সদের সবচেয়ে কাছাকাছি সম্পর্কিত।
তাদের এই দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে, হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে বিজ্ঞানীদের বিদ্যমান ধারণা বদলে যাবে, যা প্রাচীন ডিএনএ ও বছরের পর বছর ধরে খুঁজে পাওয়া জীবাশ্ম বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দ্য ইনোভেশন সাময়িকীতে খুলির বিশ্লেষণ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে।
ওই গবেষক দলের সদস্য যুক্তরাজ্যের শীর্ষ স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও লন্ডন হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অধ্যাপক ক্রিস স্ট্রিংগার বলেন, গত ১০ লাখ বছরের যেসব জীবাশ্মের খোঁজ মিলেছে, তার মধ্যে এ পর্যন্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এই খুলি।
খুলিটি থেকে প্রাচীন ডিএনএ সনশ্লেষণ সম্ভব কিনা তা যাচাই করছেন গবেষকরা। ডিএনএ সংশ্লেষণ সম্ভব হলেই এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা শুরু হবে। সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে সাইনাস, কান ও মস্তিষ্কের আকারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।
রুক্ষ পরিবেশে টিকে থাকতে ড্রাগন মানবের দেহাবয়ব বিশাল ছিল বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
একই গোত্রভুক্ত আমরা
হোমো সাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ একেবারেই আলাদা, অনন্য- এমনটা ভেবে নেওয়া খুবই সহজ। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল, যখন পৃথিবীর বুকে হোমো সাপিয়েন্স ছাড়াও মানুষের অন্যান্য প্রজাতির বাস ছিল।
প্রায় ৩ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে আফ্রিকার বুকে হোমো সাপিয়েন্সের উদ্ভবের সময় থেকেই নিয়ান্ডারথালস, ডেনিসোভানস, হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস, হোমো লুজোনেনসিস ও হোমো নালেদিসহ মানুষের অনেক প্রজাতির বাস ছিল পৃথিবীতে। এসব প্রজাতির অনেকের সঙ্গে সাপিয়েন্সরা বংশবৃদ্ধিও করেছে। এদের অনেকেরই ফসিল রেকর্ড সংরক্ষিত আছে, তবে আমাদের ডিএনও থেকেই ডেনিসোভানদের সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিনিয়তই মানব বিবর্তনের ব্যাপারে আমরা যা জানি তাতে পরিবর্তন আসছে। এটি প্যালেওঅ্যানথ্রপলজির অন্যতম চমকপ্রদ বিষয়, বলেন স্ট্রিংগার।
ইসরায়েলে সন্ধান পাওয়া ফসিল নিয়ে আরেকদল গবেষকের সায়েন্স জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার একদিন পরই ‘ড্রাগন ম্যানের’ সন্ধান পাওয়ার ঘোষণা আসে। ইসরায়েলে সন্ধান পাওয়া ওই ফসিলের গবেষণায়ও বলা হয়েছে, ফসিলটির আদিম মানুষের কোনো প্রজাতির হতে পারে, যার সন্ধান আগে পাওয়া যায়নি।
লুকোনো সম্পদ
১৯৩৩ সালে চীনের হারবিনের সংহুয়া নদীতে ব্রিজ তৈরির সময় নাম না জানা এক চীনা শ্রমিক হারবিন খুলিটি আবিষ্কার করেন বলে উল্লেখিত আহে দ্য ইনোভেশন জার্নালের এক গবেষণায়। সে সময় চীনের সেই অংশ জাপানি দখলদারত্বের অধীনে ছিল। যেই ব্যক্তি খুলিটি খুঁজে পান তিনি খুলিটি বাড়ি নিয়ে গিয়ে সুরক্ষিত রাখতে কূয়ার তলানিতে রেখে দেন।
তার জাপানি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে খুলিটি হস্তান্তর না করে তিনি সেটি একটি পরিত্যক্ত কূয়ায় চাপা দেন। ধন সম্পদ লুকানোর প্রথাগত চীনা উপায় এটি,” বলা হয় গবেষণাটিতে।
যুদ্ধ শেষে চীনে প্রচণ্ড উত্তাল সময়ে ওই ব্যক্তি চাষাবাদের কাজে ফিরে যান, পরে আর কখনো লুকিয়ে রাখা খুলিটি উদ্ধার করেননি তিনি। জাপানি দখলদারত্ব, গৃহযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও চীনে সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল পরিমাণে ফসিল বাণিজ্য সৃষ্টির এতো সব বিপত্তি পেরিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল ফসিলটি। ফলে বিজ্ঞানও এর খোঁজ পায়নি।
ওই ব্যক্তির তৃতীয় প্রজন্মের সদস্যরা তার মৃত্যুর আগে তার লুকোনো এই সম্পদের কথা জানতে পারে। ২০১৮ সালে ওই কূয়া থেকে ফসিল উদ্ধার করা হয়। গবেষণাটির একজন গবেষক কিয়াং জি খুলিতির ব্যাপারে জানতে পারেন, তার অনুরোধে ওই পরিবারটি লুকোনো সেই খুলি হেবেই জিইও ইউনিভার্সিটির জিওসায়েন্স মিউজিয়ামে দান করে।
নিকটতম আত্মীয়
নতুন সন্ধান পাওয়া এই ‘ড্রাগন ম্যান’ই বংশানুক্রমে আমাদের নিকটতম সদস্য হতে পারে। এমনকি তারা নিয়ান্ডারথালস থেকেও আমাদের আরও বেশি নিকটবর্তী প্রজাতি হতে পারে বলে উঠে এসেছে গবেষণাটিতে। তার দেহের গড়ন এবং চীনে যে অঞ্চলে সন্ধান পাওয়া গেছে, তা দেখে স্পষ্ট এই প্রজাতির রুক্ষ আবহাওয়ার সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা ছিল। তাদের মস্তিষ্ক ছিল বৃহদাকার, চোখ ছিল সুগভীর, মুখ ও দাঁত ছিল চওড়া।
আমাদের উৎপত্তি কোথা থেকে, কীভাবে আমাদের বিবর্তন হয়েছে এসব প্রশ্ন সবসময়ই চমকপ্রদ। আমরা আমাদের দীর্ঘদিনের হারানো নিকটাত্মীয়ের সন্ধান পেয়েছি,” বলেন চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষণা অধ্যাপক ও গবেষণাটির সহ-লেখক শিজুন নি।
দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউনানের ডালি ও অন্যান্য অঞ্চলে সন্ধান পাওয়া কিছু ফসিলের শ্রেনিবিভাগ নিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন গবেষকরা। ওই ফসিলগুলোও হোমো লঙ্গি প্রজাতির হতে পারে গবেষণাটিতে বলা হয়েছে।
স্ট্রিংগার আরও জানান, ড্রাগন ম্যান ডেনিসোভানেরই সদস্য এমনটাও হতে পারে।
ডেনিসোভানস ও হোমো লঙ্গি উভয় প্রজাতির বড় ও একই ধরনের দাঁতের পাটি ছিল বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়। তবে তুলনামূলক বিশ্লেষণের জন্য খুব অল্প পরিমাণে ফসিল থাকায় এখনো এটি নিশ্চিতভাবে তাদের একই কাতারে ফেলা যাচ্ছে না। আমরা এ নিয়ে সবেমাত্র বিস্তারিত গবেষণা শুরু করেছি। আগামী বেশ কিছু বছর এ নিয়ে গবেষণা চলবে, বলেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফ এ/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ