যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারতসহ চারটি দেশের কৌশলগত অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা সংলাপ বা কোয়াড নিয়ে চীন তার উদ্বেগের কথা বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বাইরের শক্তির এমন ‘সামরিক জোটের’ বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায় চীন। এজন্য চীন নানা চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে চীনের প্রস্তাবে বাংলাদেশ কোনো সাড়া দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রূপকল্পটা কী?
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের কৌশলগত জোট ‘কোয়াড’ নামে পরিচিত।
২০০৭ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিঞ্জো আবের নেতৃত্বে পথ চলা শুরু চারটি দেশের। চীনা আগ্রাসনের লক্ষ্যে বৈঠক বসে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা। ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনে ক্রমবর্ধমান সমস্যা নিয়েও নানা আলোচনা শুরু হয়। তবে সময়ের সঙ্গে একাধিক প্রতিবন্ধকতা আসে এই কোয়াডে।
বলা হয় যে এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মূলত বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যপথকে উন্মুক্ত ও নিরাপদ রাখা। এ অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্বের কারণ হচ্ছে বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীর বাস এ অঞ্চলের দেশগুলোতে এবং এসব অর্থনীতি উচ্চ ও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী। যুক্তরাষ্ট্রের এ রূপকল্পে ভারতের রয়েছে একটি বিশেষ অবস্থান।
২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ জাস্টারের বক্তব্যে এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ভারতকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও তার বাইরেও একটি নেতৃস্থানীয় শক্তির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
তার কথায়, এর লক্ষ্য হচ্ছে আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে, বিশেষভাবে ভারত মহাসাগর ও তার আশপাশে শান্তির প্রতি হুমকির ক্ষেত্রে সফলভাবে সাড়া দেওয়ায় সক্ষম ভারতকে আমাদের সমর্থন অব্যাহত রাখা।
তিনি আরও যেসব লক্ষ্যের কথা বলেছেন, সেগুলোর মধ্যে আছে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে একটি মুক্ত ও অবাধ অঞ্চল নিশ্চিত করতে সমুদ্রযান চলাচলের স্বাধীনতা, আকাশপথে বিমান চলাচল এবং বাণিজ্য ও সমুদ্রের অন্যান্য আইনসম্মত ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধান, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষা, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসারে সহায়তার কথাও বলেছেন।
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতাও চলছে জোরেশোরে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোট আসিয়ানের দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক অগ্রাধিকারের বিষয়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সামরিক জোট ন্যাটোর মতো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠনের কথাও বিভিন্ন পরিসরে আলোচিত হচ্ছে।
চীন বাংলাদেশকে পাশে চায়
গত ২৭ এপ্রিল মঙ্গলবার প্রায় সাত ঘণ্টার সফরে ঢাকায় আসেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এ সময় তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পাশাপাশি সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বাংলাদেশকে চীনের পাশে পেতে সফরের শুরুতে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এই প্রথম চীনের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শ্রদ্ধা জানাতে গেলেন।
এমনকি ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এলেও তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে যাননি। এবার সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চীনের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রীর প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল মঙ্গলবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের একপর্যায়ে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি বেইজিং-দিল্লি এবং বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্কের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এ সময় জেনারেল ওয়াং গালোয়ান উপত্যকায় ভারতের সঙ্গে গত বছরের সীমান্ত সংঘাতের প্রসঙ্গ টেনে উল্লেখ করেন, ভারত সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করায় সেখানকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তবে দুই পক্ষ আলোচনা করে সীমান্তে এখন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখেছে।
জানা গেছে, এরপর বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে গিয়ে জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি মার্চে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্যোগে আয়োজিত কোয়াড শীর্ষ নেতাদের ভার্চ্যুয়াল আলোচনার কথাটি তোলেন। অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরের নামে চীনবিরোধী একটি জোট হচ্ছে বলে রাষ্ট্রপতির কাছে মন্তব্য করেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। মার্কিন উদ্যোগ ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের (ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি—আইপিএস) বিরোধিতার কোনো ইচ্ছে চীনের নেই। চীন এ অঞ্চলের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চায়। তাই উন্নয়নের স্বার্থে শান্তি ও স্থিতিশীলতা জরুরি। চীন কারও সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায় না। তাই এ অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বাংলাদেশকে পাশে চায় চীন।
তবে সরকারের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এমন আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশার বিষয়ে রাষ্ট্রপতি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন জাতীয় ওই দৈনিককে বলেন, ‘চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে কোয়াডের প্রসঙ্গটি আলোচনায় তুলেছেন বলে জেনেছি। তিনি চীনের অবস্থানের কথা বলে গেছেন। তিনি যা বলেছেন, তা বাংলাদেশ সমর্থন করে এমনটা নয়। তিনি যা বলেছেন বাংলাদেশ শুনেছে। কৌশলগত উদ্যোগের বিষয়ে বাংলাদেশ সব সময় বলে আসছে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপাদান থাকলে বাংলাদেশ তাতে যুক্ত হবে। কোনো উদ্যোগে নিরাপত্তার বিষয়টি থাকলে বাংলাদেশ তাতে যুক্ত হবে না।’
চীনের হুঁশিয়ারি
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত জোট কোয়াডে বাংলাদেশ যোগ দিলে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি ঝিমিং।
আজ সোমবার(১০ মে) কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ-ডিকাব আয়োজিত ‘ডিকাব টক’-এ ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
লি ঝিমিং বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত জোট কোয়াডকে চীনবিরোধী একটি গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে বেইজিং। তাই চীন মনে করে, বাংলাদেশ যে কোনোভাবে এই জোটে যোগ দিলে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ হতে পারে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রাষ্ট্রদূত বলেন, চীন মনে করে কোয়াড একটি গ্রুপ এবং এটি চীনবিরোধী। আমি এটি পরিষ্কার করে বলতে চাই। কোয়াড নিজেকে অর্থনেতিক কাজে সম্পৃক্ত বলে দাবি করে, কিন্তু এটি সত্যি নয়। আমি খুব স্পষ্ট করেই বলতে চাই, অর্থনৈতিক প্রস্তাবের কথা বললেও এতে নিরাপত্তার উপাদান আছে। মূলত কোয়াড করা হয়েছে চীনের বিরোধীতার জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জাপানও এখানে চীনের বিরুদ্ধে বলছে।
তিনি বলেন, ‘এই চার সদস্য বিশিষ্ট ক্লাবে যোগ দিলে এটি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে না। কারণ এর ফলে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরের সময় দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পাশাপাশি টিকা কূটনীতি আর পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতি নিয়ে কথা বলে গেলেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
১৯৭৭ সাল থেকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাপকতর প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য কেনা সমরাস্ত্রের বড় উৎস চীন। আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম সাবমেরিনও কেনা হয়েছে চীন থেকে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ছাড়াও বিমানবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জন্য বিভিন্ন ধরনের সামগ্রীও চীন থেকে কেনা হয়েছে।
এদিকে সিনোফার্মের তৈরি পাঁচ লাখ করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আগামী বুধবার বাংলাদেশে আসছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
এ সময় চীনের রাষ্ট্রদূত জানান, চীনা কোম্পানি সিনোফার্মের তৈরি করোনার টিকার ৫ লাখ ডোজ আগামী ১২ মে বাংলাদেশে আসবে।
তিনি বলেন, উপহারের এই টিকা দিতে বাংলাদেশকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাব দিয়েছিল চীন। তবে অনুমোদনের জন্য দীর্ঘ তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। আগে অনুমতি দিলে এই টিকা আরও আগেই পেত বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রদূত আরও জানান, বাংলাদেশ শুধু সিনোফার্মের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। তাই বাংলাদেশ বাণিজ্যিকভাবে যে টিকা পেতে চায়, তার জন্য সময় লাগবে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাস্তবতার নিরিখে বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক অব্যাহত রাখা উচিত। পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতি আর মহামারির কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা বিবেচনায় নিয়ে কৌশলগত সহযোগিতার বিষয়টিকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কাজেই কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের সুফলের বিষয়টিকে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে।
তারা বলেন, ‘ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে সম্প্রতি দ্রুত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। দেশের স্বার্থ বজায় রেখে বিশেষ কোনো কৌশল বা উদ্যোগে যুক্ত হওয়াটা বাংলাদেশের জন্য সমীচীন হবে না। কারণ, এ অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকাটা জরুরি। কাজেই কোনো পক্ষেরই আগ্রাসনমূলক ভূমিকা ও পদক্ষেপ থাকাটা সমীচীন হবে না।’
তারা মনে করেন, কোয়াড যেভাবে এগোচ্ছে তাতে করে চূড়ান্তভাবে এটি সামরিক জোটে রূপ নিতে পারে। ভারত মহাসাগরে যাতে পুরোপুরি সামরিকীকরণ না হয়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ