২৫ ডিসেম্বরের রাতে ওড়িশার সম্বলপুর জেলার দানিপালি এলাকায় যে ঘটনা ঘটল, তা আর পাঁচটা বিচ্ছিন্ন অপরাধের খবরের মতো করে পড়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে কাজের খোঁজে যাওয়া ১৯ বছরের এক পরিযায়ী নির্মাণ শ্রমিক—জুয়েল রানা—‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে গণপিটুনিতে মারা গেলেন। তাঁর সঙ্গে থাকা দুই সহকর্মী গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। পরিচয়পত্র দেখানোর আগেই শুরু হওয়া মারধর, ‘জয় শ্রীরাম’ বলাতে বাধ্য করার অভিযোগ, আর রাতের অন্ধকারে হামলাকারীদের পালিয়ে যাওয়া—এই সবকিছু মিলিয়ে ঘটনাটি কেবল একজন যুবকের মৃত্যুর নয়, বরং ভারতের ভেতরেই নাগরিকত্ব, ভাষা ও ধর্মের প্রশ্নে বেড়ে ওঠা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি।
জুয়েল রানা মাত্র পাঁচ দিন আগে ওড়িশায় পৌঁছেছিলেন। মুর্শিদাবাদের সুতি অঞ্চলের চক বাহাদুরপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। পরিবারে অভাব, কাজের তাগিদ—এই চেনা বাস্তবতা তাঁকে রাজ্যের বাইরে ঠেলে দিয়েছিল। পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন এমনই; অচেনা জায়গা, অস্থায়ী বাসস্থান, দিনমজুরির কাজ, আর তার সঙ্গে সারাক্ষণ মাথার ওপর ঝুলে থাকা নিরাপত্তাহীনতা। সেই নিরাপত্তাহীনতা যে এতটা প্রাণঘাতী হতে পারে, তা হয়তো জুয়েলের পরিবার কল্পনাও করেনি। বুধবার রাতে রান্নাবান্না খেয়ে বিড়ি খেতে বেরোনোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।
সহকর্মীদের বয়ান অনুযায়ী, স্থানীয় কয়েকজন প্রথমে এসে বিড়ি চায়। কথাবার্তার মধ্যেই সন্দেহ—ওরা বাংলাদেশি কি না। আধার কার্ড দেখতে চাওয়া হয়। একজন ঘরে কার্ড আনতে গিয়েছিলেন, ঠিক তখনই মারধর শুরু। পরিচয়পত্র দেখানোর সুযোগও মেলেনি। এই মুহূর্তটাই আসলে সবচেয়ে ভয় ধরায়—কারণ এখানে প্রমাণের দায় আক্রান্তের ঘাড়ে, আর রায় ঘোষণা করে দিচ্ছে একদল উত্তেজিত মানুষ। রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসন, নাগরিক অধিকার—সব যেন মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
ঘটনার পর পুলিশ জানিয়েছে, ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তদন্ত চলছে। প্রশাসনিক ভাষায় এগুলো প্রয়োজনীয় তথ্য, কিন্তু এতে কি সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে, যেগুলো বারবার ফিরে আসে? কেন বাংলাভাষী হলেই ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহ? কেন মুসলমান হলেই সেই সন্দেহ আরও তীব্র? কেন পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর এই আক্রমণগুলো বারবার ঘটছে? জুয়েলের মৃত্যু কোনো একক ব্যতিক্রম নয়। ডিসেম্বর মাসেই বিহার, কেরালা ও ওড়িশায় তিনটি গণপিটুনিতে মৃত্যুর খবর এসেছে—তিনটি রাজ্য, তিনটি ভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট, কিন্তু সন্দেহের ভাষা প্রায় এক।
এই সন্দেহের রাজনীতির শিকড় সাম্প্রতিক কয়েক বছরে আরও শক্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ও ‘রোহিঙ্গা’ চিহ্নিত করার নির্দেশ, বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশি তৎপরতা, সীমান্তে পুশব্যাকের খবর—সব মিলিয়ে এক ধরনের সামাজিক লাইসেন্স তৈরি হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ নিজেকেই বিচারক ভাবতে শুরু করে। পরিযায়ী শ্রমিক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই পরিবেশেই হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠছে। প্রশাসনিক নির্দেশকে তারা নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করছে, আর তার ফল ভোগ করছেন সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলো—দরিদ্র, ভাষাগত সংখ্যালঘু, মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকরা।
ওড়িশায় সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্তার একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে। নির্মাণ সাইট, ইটভাটা, রাস্তার ধারের ছোট দোকান—যেখানেই এরা কাজ করেন, সেখানেই পরিচয়ের প্রশ্নে দাঁড়াতে হচ্ছে। আধার কার্ড দেখানো সত্ত্বেও সন্দেহ কাটছে না। কখনও মারধর, কখনও জোর করে স্লোগান বলানো, কখনও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ভয়। এই সব ঘটনার ভেতর দিয়ে যে মানসিক আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে, তা কেবল শারীরিক আঘাতের চেয়েও গভীর। মানুষ কাজে যেতে ভয় পাচ্ছে, বাড়ির লোকেরা প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে—“ভালো আছিস তো?”
জুয়েল রানার বাড়িতে এখন শোক আর ক্ষোভ একসঙ্গে জমে আছে। মা ছেলের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর থেকে কাঁদছেন। আত্মীয়-পরিজন ভিড় করছেন উঠোনে। ১৯ বছরের একটি জীবন—যার ভবিষ্যৎ বলতে ছিল আরও কিছু কাজের দিন, হয়তো একটু ভালো রোজগারের স্বপ্ন—সব শেষ হয়ে গেল এক রাতে। পরিবারের প্রশ্ন খুব সরল: আধার কার্ড থাকা সত্ত্বেও কেন ছেলেটা মরল? ভারতীয় নাগরিক হয়েও কেন তাকে নিজের দেশেই ‘বিদেশি’ প্রমাণ দিতে হল?
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও আসছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধায়ক ও রাজ্যের এক প্রতিমন্ত্রী অভিযোগ তুলছেন, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান বিরোধী মনোভাব বাড়ছে। অন্যদিকে, ওড়িশা সরকার প্রশাসনিক স্তরে কথা বলার আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে মাঠপর্যায়ে কী বদলাচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কারণ, গণপিটুনির ঘটনাগুলো থামছে না।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপজ্জনক যে বিষয়টি সামনে আসে, তা হলো নাগরিকত্বের ধারণার ভাঙন। ভারতীয় সংবিধান নাগরিককে ধর্ম, ভাষা বা অঞ্চলের ভিত্তিতে ভাগ করে না। কিন্তু রাস্তায়, কাজের জায়গায়, অন্ধকার গলিতে সেই সংবিধানের কোনো উপস্থিতি থাকে না। সেখানে কাজ করে ধারণা, গুজব আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর। ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি এখানে কেবল একটি জাতীয় পরিচয় নয়, বরং অপমান, সন্দেহ ও সহিংসতার কোড হয়ে উঠেছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন ভারতের অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শহরের উঁচু দালান, রাস্তা, শিল্পাঞ্চল—সবকিছুর পেছনে তাঁদের শ্রম। অথচ সেই শ্রমিকরাই সবচেয়ে কম সুরক্ষা পান। রাজ্যের সীমানা পেরোলেই তাঁদের নাগরিকত্ব যেন ঝুঁকির মুখে পড়ে। এই বাস্তবতায় জুয়েল রানার মৃত্যু একটি সতর্ক সংকেত—যদি রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজ একসঙ্গে দায়িত্ব না নেয়, তবে এই সহিংসতা আরও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
জুয়েলের সহকর্মীরা এখন হাসপাতালে। শরীরের ক্ষত সারবে হয়তো, কিন্তু অভিজ্ঞতার ক্ষত সারবে কি? তাঁরা কি আবার নিশ্চিন্তে কাজে ফিরতে পারবেন? নাকি এই ভয় তাঁদের ঘাড়ে চেপে বসে থাকবে আজীবন? আর মুর্শিদাবাদের সেই গ্রামে, যেখানে জুয়েল বড় হয়েছিল, সেখানে কি আর কেউ কাজের খোঁজে দূরে যেতে সাহস পাবে?
এই প্রশ্নগুলোর সহজ উত্তর নেই। কিন্তু একটি সত্য স্পষ্ট—‘সন্দেহের’ নামে যে সহিংসতা চলছে, তা কেবল কিছু ব্যক্তির অপরাধ নয়, বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক ব্যর্থতা। জুয়েল রানার মৃত্যু আমাদের সামনে আয়না ধরে। সেই আয়নায় আমরা যদি শুধু অপরাধীদের মুখ দেখি, নিজেদের দায় না দেখি, তাহলে হয়তো আবারও কোনো অচেনা রাতে, কোনো অচেনা শহরে, আরেকজন জুয়েল মারা যাবে।
আপনার মতামত জানানঃ