পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে নাসার সাম্প্রতিক গবেষণার পূর্বাভাস মানবসভ্যতার জন্য গভীর চিন্তার খোরাক এনে দিয়েছে। গবেষকদের মতে, আগামী প্রায় এক হাজার কোটি বছরের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে ধীরে ধীরে অক্সিজেন হারিয়ে যাবে। এই ঘটনা যদিও দূর ভবিষ্যতের, তবে এর প্রভাবের ইঙ্গিত হাজার হাজার বছর আগেই দেখা যেতে শুরু করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্যের ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া একসময় পৃথিবীর ভারসাম্য ভেঙে দেবে। আর সেই সঙ্গে বিলীন হবে প্রাণের অস্তিত্ব। এটি শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক তথ্য নয়, বরং আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
মানুষের অস্তিত্ব প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। আমরা শ্বাস নিতে পারি, কারণ গাছপালা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন তৈরি করে। কিন্তু নাসার বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, ভবিষ্যতের কোনো এক পর্যায়ে সূর্যের তীব্রতা এতটাই বেড়ে যাবে যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইড ভেঙে যাবে। কার্বন ডাইঅক্সাইড ছাড়া গাছের বেঁচে থাকা অসম্ভব, কারণ গাছ এই গ্যাস ব্যবহার করেই খাদ্য ও অক্সিজেন উৎপাদন করে। একবার উদ্ভিদ হারিয়ে গেলে পৃথিবীর অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, ধাপে ধাপে প্রাণীজগৎও নিশ্চিহ্ন হবে।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, অক্সিজেন হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বাড়বে মিথেন গ্যাসের ঘনত্ব। মিথেন একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস, যা পৃথিবীর পরিবেশকে আরও বিষাক্ত ও প্রাণঘাতী করে তুলবে। ফলে মানুষের পাশাপাশি অন্য কোনো জটিল প্রাণীর টিকে থাকা আর সম্ভব হবে না। কেবলমাত্র কিছু অণুজীব হয়তো তখনও টিকে থাকতে পারবে, যাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজন নেই। পৃথিবী একসময় পরিণত হবে শুষ্ক ও মৃত গ্রহে, যেখানে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি এসে সব জীবনের সম্ভাবনা ধ্বংস করবে।
এই ভয়াবহ চিত্রের মূল কারণ হলো সূর্যের বার্ধক্য। প্রতিটি নক্ষত্রের মতো সূর্যও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে এর তাপমাত্রা বাড়ছে, শক্তি বিকিরণ বাড়ছে এবং এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে পৃথিবীর ওপর। বর্তমানে সূর্য পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য হলেও ভবিষ্যতে সেটিই হয়ে উঠবে প্রাণহানির কারণ। সূর্যের অতিরিক্ত উত্তাপ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গ্যাসগুলোকে ভেঙে ফেলবে। ফলস্বরূপ গাছপালা অক্সিজেন তৈরি করতে পারবে না, প্রাণীরা শ্বাস নিতে পারবে না, আর মানুষ একেবারেই বিলীন হয়ে যাবে।
তবে বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা কেবল ভবিষ্যতের এক ভয়ঙ্কর ছবি আঁকার জন্য করেননি। তাদের মূল বার্তা হলো পৃথিবী কোনোভাবেই চিরকাল বসবাসযোগ্য নয়। আমাদের অস্তিত্ব একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যা যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে যদি আমরা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করি, তবে অক্সিজেন সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য বিপর্যয় অনেক আগেই মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলতে পারে। অর্থাৎ, যেটি কোটি কোটি বছর পরে হওয়ার কথা, সেটির আংশিক চিত্র আমরা হয়তো কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই দেখতে পাব।
বিজ্ঞানীরা এও উল্লেখ করেছেন যে, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে যখন অক্সিজেন থাকবে না, তখন জীবনের একমাত্র সম্ভাবনা থাকবে অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে অভিযোজিত কিছু অণুজীবের মধ্যে। এগুলো হয়তো তখনও টিকে থাকতে পারবে, কিন্তু জটিল প্রাণ বা মানুষের মতো উন্নত জীবনের জন্য কোনো পরিবেশ তখন আর থাকবে না। ওজোনস্তরও তখন ধ্বংস হয়ে যাবে, ফলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে সরাসরি এসে আঘাত হানবে। অতিবেগুনি রশ্মি প্রাণঘাতী, এটি ডিএনএ ভেঙে দিতে পারে এবং নতুন প্রাণের জন্ম হওয়াকে পুরোপুরি অসম্ভব করে তুলতে পারে। পৃথিবী হবে এক মৃত গ্রহ, যেখানে আর কোনো জীবন নেই।
এই তথ্য শুনে আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাবতে পারেন—এক হাজার কোটি বছর তো অনেক সময়, এখনই কেন চিন্তা করতে হবে? কিন্তু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে, দূর ভবিষ্যতের এ দৃশ্যের ইঙ্গিত হাজার হাজার বছর আগেই দেখা দিতে শুরু করবে। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন, গ্রীনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো ইতিমধ্যেই মানবসভ্যতাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা যদি এখনই পরিবেশ রক্ষায় মনোযোগী না হই, তবে প্রকৃতির ভারসাম্য ভেঙে গিয়ে মানবসভ্যতা অনেক আগেই মারাত্মক সংকটে পড়তে পারে।
এই গবেষণার একটি বড় শিক্ষা হলো—আমরা প্রকৃতিকে যেমন পাই, সেটি তেমনই থাকবে না। পৃথিবী সব সময় বসবাসযোগ্য থাকবে, এমনটি ভাবা ভুল। সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পৃথিবীর অস্তিত্ব ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী। তাই মানুষের দায়িত্ব হলো পরিবেশকে রক্ষা করা, প্রকৃতিকে যত্ন নেওয়া এবং সচেতন থাকা। বনভূমি ধ্বংস, শিল্পকারখানা থেকে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের অস্তিত্বকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আজকের পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে সঠিক সিদ্ধান্ত ও দায়িত্বশীল আচরণের ওপর। পরিবেশ সচেতনতা ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী উপহার দেওয়া সম্ভব নয়। নাসার এই সতর্কবার্তা কেবল একটি বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস নয়, বরং এটি আমাদের জন্য একটি দিকনির্দেশনা। মানুষ যদি আজ থেকেই প্রকৃতিকে রক্ষা করার পথে না হাঁটে, তবে হয়তো অক্সিজেন সংকটের ভয়াবহ ছবি দূর ভবিষ্যতের আগেই বাস্তব হয়ে উঠবে।
সর্বোপরি বলা যায়, পৃথিবীর অক্সিজেন একদিন শেষ হয়ে যাবে, এটি অনিবার্য সত্য। তবে সেই দিনের আগেই যদি মানুষ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে, তবে অক্সিজেনের সংকট এবং প্রাণের বিলুপ্তি অনেক দ্রুত চলে আসতে পারে। তাই আমাদের সামনে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা চাইলে প্রকৃতিকে রক্ষা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দিতে পারি। নাহলে, আজ থেকে কোটি কোটি বছর পর নয়, অচিরেই পৃথিবী পরিণত হবে এক মৃত গ্রহে।
আপনার মতামত জানানঃ