বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে দেশটি—যেখানে জনগণের একাংশ বিচার ব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, আর সরকার তার মুখে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও বাস্তবতায় তার প্রতিফলন খুবই ক্ষীণ। অন্তর্বর্তী সরকারের মাত্র সাত মাসেই দেশে ১১৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যাতে নিহত হয়েছেন ১১৯ জন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৭৪ জন। এ ধরনের সহিংসতার প্রতিটি দৃশ্য যেন মানবাধিকারের উপর এক নির্মম আঘাত, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত প্রমাণপত্র।
এই সময়কালে গণপিটুনি, গণধোলাই, হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে সংখ্যালঘুদের হেনস্তার মতো ঘটনা সামনে এসেছে ধারাবাহিকভাবে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরানো থেকে শুরু করে লালমনিরহাটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বাবা-ছেলেকে জনতার হাতে হেনস্তা, ঢাকায় নারী হেনস্তাকারীকে মাথায় পাগড়ি ও গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করার ঘটনাগুলো যেন এক ভয়ঙ্কর বার্তা ছড়াচ্ছে—আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে জনগণের শাসনের এক অসভ্য রূপই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কয়েক সপ্তাহে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ফিরে না আসা কিছুটা বোঝা গেলেও, দশ মাস পরও যখন গণপিটুনি ও মাজার ভাঙচুর অব্যাহত থাকে, তখন সেটিকে আর কাকতালীয় কিংবা ত্বরিত উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ বলা যায় না। বরং সেটা এক রাজনৈতিক ব্যর্থতা, অথবা সচেতন প্রশ্রয়ের ফল। এ পরিস্থিতিতে যখন সরকার নিজেই একাধিকবার মব ভায়োলেন্সকে বরদাশত না করার কথা বলেছে, তখন প্রশ্ন উঠে, সেই বক্তব্য কী শুধু সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে ঘোষণার জন্য, নাকি তার বাস্তবায়নেও কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?
জনগণের একাংশ মনে করে, সরকার হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় বা মতাদর্শিক গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় থাকতে চায়, তাই তারা সহিংস মবকে প্রতিরোধে সচেষ্ট নয়। আবার এমন কথাও উঠছে—যে কোনো অপরাধে জড়িতদের মব বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা কি বিচারপ্রক্রিয়ার পথ রুদ্ধ করছে না? অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিরোধ, ব্যক্তিগত শত্রুতা, বা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ঘটনাকে ‘মব জাস্টিস’ রূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে—যার ফলে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
যখন জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হচ্ছে, মব জাস্টিস হলো মানবাধিকারের ভয়ানক লঙ্ঘন, তখন প্রশ্ন ওঠে—এই বাস্তবতাকে থামাতে সরকারের কী কার্যকর পদক্ষেপ রয়েছে? শুধু ‘কঠোর হব’ বললেই কি একটি মাজারে হামলার পর কেউ ঘটনাস্থলে যাবে না? একজন ইমামকে মিথ্যা অভিযোগে পিটিয়ে মারার পর তার এতিম কন্যার কাছে কেউ সান্ত্বনা নিয়ে যাবে না? পুলিশের ওপর ৬ মাসে ২২৫টি হামলা হবে, অথচ মন্ত্রণালয় বা প্রধান উপদেষ্টা কেউ তাদের পাশে দাঁড়াবে না? তাহলে কীভাবে এই বার্তা পৌঁছায় যে সরকার সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না?
আবার, স্থানীয় পর্যায়ে উপস্থিত না হয়ে শুধুমাত্র ঢাকায় বসে হুঁশিয়ারি দিলে, স্থানীয় প্রশাসনের ওপর তার কতটা প্রভাব পড়ে—তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। মাঠ প্রশাসন তখন দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে—তারা কি জনগণের চাপে নতি স্বীকার করবে, নাকি সরকারের কথায় ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে? আর এই দ্বিধার সুযোগে মব আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে।
এই ঘটনাগুলোর প্রতিটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, রাষ্ট্র নামক কাঠামো কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে রাষ্ট্র মাজারে হামলা, মসজিদের ইমামের হত্যাকাণ্ড বা সংখ্যালঘুদের হেনস্তা ঠেকাতে পারে না, আবার সে-ই রাষ্ট্র সংবাদ সম্মেলনে ‘শক্ত হাতে দমন’ করার কথা বলে—তাকে আর কতটুকু বিশ্বাস করা যায়? বিশেষ করে যখন দেখা যায়, ঢাকায় এক অভিযুক্ত নারী হেনস্তাকারীর মুক্তির দাবিতে চাপ দেওয়া হয়, আর জামিন পেয়ে গেলে তাকে পাগড়ি ও ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়—সে সংখ্যাগরিষ্ঠের মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ভয় পায়।
এই বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় সংকট হলো—জনগণ যদি মনে করতে শুরু করে, রাষ্ট্র নিজেই এই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাহলে সামাজিক চুক্তি ভেঙে পড়ে। তখন কোনো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে না, কোনো ন্যায়ের প্রতি আস্থা থাকে না। এমনকি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যরাও নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারে না।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো—সরকারের আন্তরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনআস্থার প্রতিফলন। মব ভায়োলেন্সের প্রতিটি ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত, দ্রুত বিচার, এবং অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা ছাড়া এর কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায়, বাংলাদেশ সত্যিই এক ‘মবের মুল্লুকে’ পরিণত হবে, যেখানে আইনের বদলে চলবে ক্ষোভ, প্রতিহিংসা ও ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলার রাজত্ব।
আপনার মতামত জানানঃ