সুইস ব্যাংকে হঠাৎ বাংলাদেশিদের আমানতের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার এক জটিল চিত্র তুলে ধরেছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্র্যাংকে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এটি গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হলেও, ২০২১ সালের রেকর্ড ৮৭ কোটি ফ্র্যাংকের তুলনায় কিছুটা কম। তবু এই হঠাৎ বৃদ্ধিকে বিশেষজ্ঞরা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করছেন।
২০২৪ সাল বাংলাদেশের জন্য ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত অস্থির। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের পতন ঘটে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে। সেই পরিবর্তনের আগে-পরে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত, বিত্তশালী ও প্রভাবশালীদের একটি বড় অংশ দেশ ছাড়ে এবং অনেকেই তাদের সম্পদ নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেন। সুইস ব্যাংকে এই আমানতের উল্লম্ফন তারই পরিণাম বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের ভাষায়, রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে ক্যাপিটাল ফ্লাইট বেড়ে যায় এবং এর বড় একটি অংশ ঘটে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্তরালেই। এমনকি টিউশন ফি বা আমদানি-রপ্তানির ওভার ইনভয়েসিংয়ের মতো কৌশলে বৈধ রূপে শত শত কোটি টাকা বিদেশে চলে যায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, এই টাকা কতটা বৈধ আর কতটা অবৈধ, সেটি নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও অনুমান করা যায় যে সিংহভাগ অর্থই কালো টাকা। কারণ, বাংলাদেশ এখনো “কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড” নামক আন্তর্জাতিক তথ্য বিনিময় ব্যবস্থায় যোগ দেয়নি। যদি এই ব্যবস্থায় দেশটি অংশ নিত, তবে বিদেশে জমা অর্থের প্রকৃতি, উৎস, মালিকানাসহ অনেক কিছু জানা যেত। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের সময়ে এই উদ্যোগ দেখা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের এখন সেই সুযোগ থাকলেও তারা কতটা কার্যকরভাবে তা গ্রহণ করছে, তা স্পষ্ট নয়।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন এটিকে “অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য ঘটনা” বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ব্যাংক খালি করে ঋণের টাকা, ওভার ইনভয়েসিং, শেয়ারবাজারে কারসাজি এবং সাধারণ আমানতকারীদের টাকা পর্যন্ত পাচার করে এই বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে স্থানান্তর হয়েছে। এটি নিছক কাকতালীয় নয়, বরং সুপরিকল্পিত অর্থপাচারের অংশ হিসেবে বিবেচনা করছেন তিনি। তাঁর মতে, যারা অর্থ পাচার করেছে তারা মূলত ধনিক শ্রেণির সেই অংশ যারা সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে নানা সুবিধা ভোগ করেছে এবং সরকার পতনের আগেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছিল।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকার ওপরে অর্থ পাচার হয় শুধু আমদানি-রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে। এই প্রবণতা থামানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলত দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাবে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে — আন্তর্জাতিক তথ্য বিনিময় ব্যবস্থায় যোগদান এবং সুইস ব্যাংকে যেসব অর্থ জমা হয়েছে তার উৎস সম্পর্কে জানা। এতে দেশীয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে, অবৈধ অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটা শক্ত বার্তা যাবে যে, দেশের সম্পদ বিদেশে সরানো যাবে না বিনা প্রতিক্রিয়ায়।
একই সঙ্গে এটি প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সাথে অর্থনৈতিক দুর্নীতি হাত ধরাধরি করে চলে। রাজনৈতিক পতনের আগেই সেই দুর্বৃত্তরা নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছে এবং এখন বিদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের একটি বড় অংশ বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ব্যাংকে, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে তাদের অর্থ সঞ্চিত রেখেছে।
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় এ ধরনের অর্থ পাচার রোধ করতে হবে কঠোর হাতে। এবং এর জন্য চাই আন্তঃদেশীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্তি, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দুর্নীতিবিরোধী শক্তিশালী পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের জন্য এটা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটেরও প্রতিফলন। সুইস ব্যাংকে জমা বাংলাদেশিদের এই বিপুল অর্থ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, দুর্নীতি আর দুর্বল শাসনব্যবস্থা কিভাবে একটি জাতির ভবিষ্যৎকে বিদেশি ব্যাংকের গোপন কুঠুরিতে বন্দি করে ফেলে। সময় এসেছে সেই দরজাগুলো খুলে জাতীয় সম্পদকে ফিরিয়ে আনার, আর ভবিষ্যতে যেন তা আবার না ঘটে — সেই নিশ্চয়তা গড়ার।
আপনার মতামত জানানঃ