মানবজাতির উৎপত্তি ও বিবর্তনের প্রশ্নটি দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আমরা জানি, পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব প্রাণী ছিল এককোষী এবং সম্পূর্ণ জলজ। ধীরে ধীরে এই সরল প্রাণীরা বিবর্তনের মাধ্যমে জটিল জীবরূপে রূপান্তরিত হয়। তাহলে কি মানুষের শিকড় সেই জলজ জীবগুলোর কাছেই খুঁজে পাওয়া যায়?
জলজ প্রাণী থেকে স্থলচর প্রাণীতে রূপান্তরের পেছনে রয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরাট ভূমিকা। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের ‘বিবর্তন তত্ত্ব’ মতে, সব জীবজন্তু ধাপে ধাপে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। ডারউইন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ On the Origin of Species-এ উল্লেখ করেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বেঁচে থাকা উপযুক্ত প্রাণীগুলোই তাদের বংশ বজায় রাখতে পেরেছে।
বলা হয়ে থাকে, প্রায় ৩৭৫ মিলিয়ন বছর আগে কিছু জলজ প্রাণী, যেমন টিকটালিক নামের একটি অদ্ভুত রকমের মাছ, যাদের পাখনার মতো অঙ্গ থাকলেও ভেতরে হাড়ের কাঠামো ছিল, ধীরে ধীরে জল ছেড়ে স্থলে উঠে আসে। তাদের থেকেই বিবর্তিত হয় উভচর প্রাণী, এরপর সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী এবং শেষমেশ মানুষের পূর্বপুরুষ।
মানবদেহে এখনো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আমাদের জলজ অতীতের ইঙ্গিত দেয়। যেমন, গর্ভাবস্থায় ভ্রূণ একটি তরল পরিবেশে বিকশিত হয়; ভ্রূণের গঠনের এক পর্যায়ে তার গলায় গিলস্লিট (gill slits)-এর মতো গঠন দেখা যায়, যা মাছের শ্বাসপ্রশ্বাসের অঙ্গের মতো। যদিও মানব ভ্রূণের এসব গঠন পরবর্তীতে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়, তবুও এগুলো প্রমাণ করে যে মানুষের পূর্বপুরুষরা একসময় জলজ ছিল।
এছাড়াও, মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কিছুটা অস্পষ্ট ও জটিল। শ্বাস বন্ধ রেখে ডুব দেওয়ার ক্ষমতা, চোখের লেন্সের পানির ভেতরে ফোকাস করার সামর্থ্য, এমনকি আমাদের কানপথে থাকা ছোট হাড়গুলোও জলজ প্রাণীর সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য বহন করে। এসব বৈশিষ্ট্য কিছু বিজ্ঞানীকে এই তত্ত্বের দিকে টানছে যে মানুষ হয়তো এক পর্যায়ে ‘Aquatic Ape Hypothesis’ বা ‘জলীয় মানব তত্ত্ব’-এর অন্তর্গত কিছু বিবর্তন পর্যায় অতিক্রম করেছে।
তবে, এটি বলে রাখা দরকার যে, বিজ্ঞানীদের মাঝে এই বিষয়ে একমত নেই। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, ‘Aquatic Ape Hypothesis’ এখনও পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে অনুমানভিত্তিক। প্রথাগত বিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে মানুষ হলো শুক্র ও ডিম্বাণুর সংমিশ্রণে গঠিত স্তন্যপায়ী প্রাণী, যার বিবর্তন ঘটেছে গাছ থেকে নামা বানর সদৃশ প্রাণীর মাধ্যমে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জলজ পর্বটিকে শুধুমাত্র মানব বিবর্তনের একটি দূরবর্তী পূর্বসূরির অংশ হিসেবে ধরা হয়।
তবুও, মানুষের শরীরের গঠন ও বিকাশ পর্যায়ে জলজ বৈশিষ্ট্যের ছাপ প্রমাণ করে যে, প্রাণের ইতিহাসে জলের ভূমিকা অসীম। মানুষ সরাসরি আধুনিক জলজ প্রাণী থেকে উদ্ভূত না হলেও, তার অতীতে সেই জলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যা আজও জীববিজ্ঞানের নানা পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।
মানুষ কি জলজ প্রাণীর বিবর্তিত রূপ? সরাসরি না হলেও, উত্তরটি ঘুরেফিরে একটাই—হ্যাঁ, মানুষের জীববিজ্ঞানী পূর্বপুরুষেরা একসময় জলেই বাস করত। প্রকৃতি ও পরিবেশের হাত ধরে তারা বিবর্তিত হয়ে আজকের জটিল মানবদেহে পরিণত হয়েছে। ফলে, মানুষের ইতিহাস শুধু স্থলের নয়, জলেরও এক অমোঘ উপাখ্যান
আপনার মতামত জানানঃ