নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ ছিল দেড় হাজার কোটি টাকা। নামেমাত্র এসব প্রশিক্ষণের বরাতে খরচ হয়ে গেছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। বিপুল এই অর্থব্যয় হলেও যথাযথভাবে হয়নি প্রশিক্ষণ। এমনকি খরচ না হওয়া দেড়শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে একটি চক্র। বিপুল পরিমাণ এই আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সূত্রমতে, সার্ফেস স্ট্যাডির খুব একটা গুরুত্ব না দিয়েই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এমনকি স্টেকহোল্ডারদের মন্তব্যও তারা গ্রহণ করেনি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে ক্ষোভ। শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেয়া চার শিক্ষক ও একজন প্রশিক্ষক জানান, এই ট্রেনিংগুলো মূলত হয়েছে অনলাইন বেইজড। যাতে ভিডিও দেখে একটি অনলাইন পরীক্ষার আয়োজন করা হতো। যা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের কন্টেন্ট। আর সরাসরি ট্রেনিংগুলো ছিল মূলত আওয়ামী লীগ সরকার বন্দনার মঞ্চ।
নজরুল ইসলাম নামে একজন শিক্ষক বলেন, অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা বেসিক কারিকুলামের ধারণাটাও পাইনি। আমরা কীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবো কিংবা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে সে বিষয়টিরও ধারণা মেলেনি। এ ছাড়াও সরাসরি ট্রেনিংও অনুষ্ঠিত হয় শিক্ষকদের। অনেক শিক্ষক কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই ক্লাস নিয়েছেন শিক্ষার্থীদের। আরিফুল ইসলাম সরাসরি অনুষ্ঠিত হওয়া ট্রেনিংয়ের বিষয়ে বলেন, এগুলো মূলত ছিল জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানের মতো। বক্তা ভাষণ দিচ্ছেন ডায়াসে। যার অর্ধেক থাকতো সরকারের গুণগান আর শিক্ষাক্রমের প্রশংসা। বাস্তবিক অর্থে কীভাবে শিক্ষা দিতে হবে তা নিয়ে আলোচনা হতো খুবই কম। আর কিছু কাগজ দেয়া হতো প্রশিক্ষণের আলোকে তা দিয়েই আমাদের কন্টেন্ট বুঝতে হতো। এই কাগজগুলোও ছিল অসম্পূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, সপ্তাহব্যাপী এসব ট্রেনিংয়ে মাস্টার প্রশিক্ষক হিসেবে আমাদের প্রস্তুত করা হয়। এরপর আমরা অন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতাম। কিন্তু এগুলো বাস্তবতা হলো বিষয়ভিত্তিক ট্রেনিং যারা করাতেন তারা নিজেই কতোটুকু বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এরকম নামকাওয়াস্তে প্রশিক্ষণেই খরচ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। আবার বাজেটের বাকি দেড়শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেবার ফন্দিতে আছে একটি চক্র। এনসিটিবি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, এসব গঠিত তদন্ত কমিটি মূলত এনসিটিবি’র সাবেক সদস্য (কারিকুলাম) মো. মশিউজ্জামান ও তার অনুগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ অপচয়ের অভিযোগে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করবেন। তাদের উদ্দেশ্য সরকারের কতো টাকা গচ্চা গেছে তার একটি বিবরণী তৈরি করা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় গত ২৪শে অক্টোবর ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে এনসিটিবি। এ ছাড়াও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে আরও ৪ এনসিটিবি’র কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন এনসিটিবি’র প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা প্রফেসর মো. নজরুল ইসলাম। সদস্য হিসেবে আছেন উৎপাদন নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মোহাম্মদ আবু নাসের টুকু, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ (প্রাথমিক) মো. আব্দুল মুমিন মোছাব্বির, বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান। এ ছাড়াও সদস্য সচিব হিসেবে আছেন বিশেষজ্ঞ (মাধ্যমিক) মীর রাহাত মাসুম। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করতে এনসিটিবি’র ৪ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন এনসিটিবি’র ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) সাইফা সুলতানা, গবেষণা কর্মকর্তা (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ (মাধ্যমিক) ড. প্রবীর চন্দ্র রায়, গবেষণা কর্মকর্তা (মাধ্যমিক) শাহ্ মো. জুলফিকার রহমান। এনসিটিবি’র সচিব শাহ মুহাম্মদ ফিরোজ আল ফেরদৌস স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়।
অভিযোগ উঠেছে, যাদের নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে তারাই ছিলেন সুবিধাভোগী ছিলেন। শ্বেতপত্রটি স্বাক্ষর করবেন এনসিটি সচিব। তার গ্রিন সিগন্যালের পরই যাবে মন্ত্রণালয়ে। সচিব পূর্বে এনসিটিবিতে উপসচিব (প্রশাসন) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই কর্মকর্তা একাই চার চারবার এনসিটিবিতেই পদায়ন নিয়েছেন। শুধু এনসিটিবিতে নয়, আওয়ামী আমলে পুরো শিক্ষা প্রশাসনে ফিরোজ আল ফেরদৌস সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ভাগ্নে পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। আবার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির আর্থিক বিভিন্ন অনিয়ম আর ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন মো. মাহফুজ আলী। বর্তমানে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) বদলি হয়েছেন। তিনি নানা রকম ভুয়া ভাউচার দিয়ে বাকি অর্থটাও হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন। পরিস্থিতি বুঝে একটি চক্র ডিউ বিলের জন্য প্রায়শই তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। বেনামে একটি বিলের কপিও জমা পড়েছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রিয়াজুল হাসান বলেন, আর্থিক অনিয়মের বিষয়াদি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত কাজ শেষ করার। এরপর খতিয়ান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রেরণ করবো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পক্ষপাতিত্ব হওয়ার সুযোগ নেই। এনসিটিবিতে যারা কর্মরত আছেন তাদের কাছ থেকে তথ্য চেয়ে নেয়া হবে। যার কাছে যে তথ্য আছে সেটা তারা প্রদান করবেন। আমরা কমিটি গঠন করে দিয়েছি, তারা সকল স্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য চেয়েছেন। নিয়মমাফিক বিষয়গুলো নিয়ে তারা কাজ করবে।
আপনার মতামত জানানঃ