মানুষ যখন হাজার হাজার বছর আগে ফসল চাষ শুরু করেছিল, তখন কৃষিকাজ লক্ষ লক্ষ বছর আগে থেকেই ছিল। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের একটি প্রজাতি হিসাবে বিবর্তিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই বেশ কয়েকটি প্রাণীর বংশ তাদের নিজস্ব খাদ্য বৃদ্ধি করে আসছে।
একটি নতুন গবেষণা অনুসারে, ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে যখন একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানে তখন পিঁপড়ার উপনিবেশগুলি ছত্রাকের চাষ শুরু করে। এই প্রভাব বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিলুপ্তি ঘটায় তবে ছত্রাকের বিকাশের জন্য আদর্শ পরিস্থিতিও তৈরি করে। উদ্ভাবনী পিঁপড়া ছত্রাকের চাষ শুরু করে, একটি বিবর্তনীয় অংশীদারিত্ব তৈরি করে যা ২৭ মিলিয়ন বছর আগে আরও শক্তভাবে জড়িত হয়ে ওঠে এবং আজও অব্যাহত রয়েছে।
সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে , স্মিথসোনিয়ানের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির বিজ্ঞানীরা বিশদ বিবর্তনীয় গাছ তৈরির জন্য শত শত প্রজাতির ছত্রাক এবং পিঁপড়া থেকে জেনেটিক ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন। এই গাছগুলির তুলনা গবেষকরা পিঁপড়ার কৃষির একটি বিবর্তনীয় সময়রেখা তৈরি করতে এবং পিঁপড়ারা প্রথম ছত্রাক চাষ শুরু করার সময় চিহ্নিত করতে দেয়।
“পিঁপড়ারা মানুষের অস্তিত্বের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে কৃষি ও ছত্রাক চাষের অনুশীলন করে আসছে,” বলেছেন কীটতত্ত্ববিদ টেড শুল্টজ, যাদুঘরের পিঁপড়ার কিউরেটর এবং নতুন কাগজের প্রধান লেখক৷ “আমরা সম্ভবত গত ৬৬ মিলিয়ন বছরে এই পিঁপড়াদের কৃষি সাফল্য থেকে কিছু শিখতে পারি।”
গ্রহাণুর আঘাতের ফলে ওই সময় পৃথিবীতে তৈরি হয় কম আলোর এক অদ্ভুত পরিবেশ, যেটি ছত্রাকের বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত ছিল।
৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে এক বিশাল গ্রহাণু আঘাত হানে পৃথিবীতে, যা ডাইনোসরদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মকভাবে বদলে দেয় পৃথিবীকেও।
এ বিপর্যয়ের ফলে সেই সময় মারা যায় পৃথিবীতে বাস করা অনেক গাছপালা ও প্রাণী। তবে ওই পরিবেশ, মানুষের চেয়েও কোটি বছর আগের পৃথিবীর প্রথম দিকের কৃষক হওয়ার এক নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল পিঁপড়াদের জন্য।
গ্রহাণুর আঘাতের ফলে ওই সময় পৃথিবীতে তৈরি হয় কম আলোর এক অদ্ভুত পরিবেশ, যেখানে ছত্রাক অর্থাৎ মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণী খায় এমন জীব বেড়ে ওঠে।
আর ভয়াবহ সে সময় আসলে সুসময় হিসাবে দেখা দেয় পিঁপড়ার এমন এক দলের কাছে যারা খাবারের জন্য ছত্রাক চাষ শুরু করে বলে উঠে এসেছে এক গবেষণায়। আর এটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ।
গবেষকরা বলছেন, সে সময় ছত্রাক চাষ শুরু করে কিছু পিঁপড়া, যেটি নির্দেশ করে ‘অ্যান্ট এগ্রিকালচার’-এর সূচনাকে।
বর্তমান সময়ের পিঁপড়া চাষ করে এমন ৪৭৫টি প্রজাতির ছত্রাকের জিনোম গবেষণা করে এসব প্রাচীন পিঁপড়ার টাইমলাইন খুঁজে বের করেছেন বিজ্ঞানীরা।
এজন্য জিনোমের ‘আল্ট্রাকনজার্ভড এলিমেন্টস বা ইউসিই’-এর দিকে নজর দেন গবেষকরা। জিনোমের এক প্রাচীন অঞ্চল ‘ইউসিই’, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খুব বেশি বদলে যায় না।
এসব ‘ইউসিই’-এর আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্লেষণ করে পিঁপড়ার পাশাপাশি এসব ছত্রাক কীভাবে বিবর্তিত হয়েছিল তার এক বিস্তারিত সময়রেখা তৈরি করেন বিজ্ঞানীরা।
দুই ধরনের ছত্রাক খুঁজে পান গবেষকরা, যেগুলো চাষ হয় আধুনিক সময়ের পাতাকাটা পিঁপড়ার মাধ্যমে। প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে গ্রহাণুর আঘাতের পর প্রায় একই সময়ে জন্মেছে এরা।
এসব ছত্রাকের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ‘আত্তিনি’ নামের পিঁপড়াদের, খাবারের জন্য ছত্রাকের উপর নির্ভর করত এসব পিঁপড়া। একইসঙ্গে ছত্রাকও প্রজনন ও বেঁচে থাকার জন্য নির্ভরশীল ছিল পিঁপড়ার উপর।
এই ‘মিউচুয়ালিজম’ সম্পর্কটি ছিল মূল অভিযোজনের মতোই, যা পিঁপড়া ও ছত্রাক উভয়কেই কঠিন সময়ে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে, অন্যান্য খাদ্য উৎসের সংকটের বেলায়।
মূলত জৈব পদার্থকে ভেঙে ফেলে ছত্রাক, যা নিজেদের বাসায় নিয়ে যায় পিঁপড়ারা এবং ছত্রাকের তৈরি পুষ্টি খায় পিঁপড়া। আর এই অংশীদারিত্ব এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, ছত্রাক ছাড়া বাঁচতে পারে না পিঁপড়া।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, প্রায় দুই কোটি ১০ লাখ বছর আগে পিঁপড়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ‘প্রবাল ছত্রাক’ নামে পরিচিত এক ভিন্ন ধরনের ছত্রাকের চাষ। ক্ষুদ্র প্রবাল প্রাচীরের মত দেখতে হওয়ায় এমন নাম রাখা হয়েছে এসব ছত্রাকের।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছত্রাক চাষে আরও সক্ষম হয়ে ওঠে পিঁপড়া। তবে পিঁপড়ারা ঠিক কীভাবে এটি করে সে সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত নন বিজ্ঞানীরা।
পিঁপড়াদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল কৃষির এই প্রাথমিক রূপটি। বর্তমানে পিঁপড়ার মাধ্যমে চাষ করা ছত্রাক কেবল নিজেদের বেঁচে থাকার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং মানুষকে সাহায্য করারও সম্ভাবনা রয়েছে এর, যা নিয়ে চলছে গবেষণা।
এই প্রাচীন পিঁপড়া-ছত্রাকের অংশীদারিত্ব থেকে ইঙ্গিত মেলে, অপ্রত্যাশিতভাবে কীভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে পৃথিবীতে বাস করা বিভিন্ন জীব, এমনকি বিপর্যয়ের মুখেও।
আপনার মতামত জানানঃ