ভাটির দেশ হিসেবে ভৌগোলিকভাবে অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় বাংলাদেশে বারবার বন্যা হচ্ছে। হিমালয়ের ধার বেয়ে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা অববাহিকার বিপুল আয়তনের পানি শেষমেশ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এই তিন নদীর মিলিত প্রবাহ যখন মেঘনা হয়ে সমুদ্রে নামে, এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম, প্রথম আমাজন।
মূলত বাংলাদেশের তিন দিক থেকেই পানি দেশের ভেতরে আসছে। উত্তরে হিমালয়ের বিশাল অববাহিকা, আবার পূর্বেও ভারত ও মিয়ানমারের পাহাড়ি ঢাল বেয়ে পানি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এবারকার বন্যার পানি এসেছে পূর্ব দিক থেকে। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টির ধরন পরিবর্তিত হচ্ছে। ‘ক্লাউড ব্লাস্ট’ বা অল্প সময়ে তীব্র বৃষ্টি তেমনই একটি নতুন প্রভাব।
আসলে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর প্রায় অধিকাংশই ভারতে উৎপন্ন। ভারতের সঙ্গে এ ধরনের অভিন্ন নদী আছে প্রায় ৫৪টি। মিয়ানমারের সঙ্গে বাকি কয়েকটি। যেমন লুসাই পাহাড় থেকে কর্ণফুলী আর সীমান্ত ঘেঁষে নাফ নদী। শুধু একটি বড় নদ ‘সাঙ্গু’কে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের ভেতর থেকে উৎপন্ন হয়ে সাগরে পড়েছে।
এর ফলে দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পানির প্রায় ৯২ শতাংশ আসলে দেশের বাইরের বৃষ্টি থেকে উৎপন্ন, কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে থাকে। প্রায় প্রতিটি নদীর ওপর অজস্র বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে আরও বেকায়দায় ফেলে রেখেছে। এর ফলে বর্ষায় শুধু বন্যা নয়, একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে খরা ও লবণাক্ততার সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে দেশের একটা বড় অংশ।
এখন বাংলাদেশ অংশে বাঁধ তথা পানি অবকাঠামো নির্মাণ করে এর পাল্টাজবাব দেওয়া সম্ভব কি না? আজকাল এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এটি বেশ জটিল প্রশ্ন! তবে তার আগে একটু আলোচনা করা যাক যে সমঝোতার মাধ্যমে, তথা দ্বিপক্ষীয় পানি চুক্তি কিংবা আইনের আশ্রয়ের দ্বারা এ সমস্যার সমাধান সম্ভব কি না?
চুক্তি বা আইন দ্বারা কি সমস্যা সমাধান সম্ভব
ঠিক এ মুহূর্তে জাতিসংঘের অধীন যে আইন আন্তর্জাতিক নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে সরাসরি জড়িত, তা হচ্ছে ‘দ্য কনভেনশন অন দ্য ল অব নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্স’, ১৯৯৭। ২১ মে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘে আইনটি প্রাথমিকভাবে উত্থাপিত হলে ১০৩টি দেশ এর পক্ষে সায় দেয়, ৩টি দেশ বিপক্ষে এবং ভারতসহ ২৭টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়মানুযায়ী জাতিসংঘ আইনটিকে প্রয়োজনীয় মনে করে এই শর্ত আরোপ করে যে অন্তত ৩৫টি দেশ নীতিগতভাবে অনুমোদন বা ‘রেটিফিকেশন’ করে স্বাক্ষর করলে এটি একটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হবে। ১৭ আগস্ট ২০১৪-এ পর্যাপ্তসংখ্যক দেশ প্রস্তাবনাটিতে স্বাক্ষর করায় তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়।
৩০ এপ্রিল ২০১২ সালে আমি প্রথম আলোয় ‘আন্তর্জাতিক পানি আইন-বাংলাদেশ নীতিগত অনুমোদন দিচ্ছে না কেন?’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। তখন পর্যন্ত ২৪টি দেশ এটিতে স্বাক্ষর করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশ করেনি। এটি ছিল আশ্চর্যজনক। কেননা বাংলাদেশের জন্য এই আইন ছিল আর যেকোনো রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মজার কথা হচ্ছে, ২০০১ থেকে ২০০৬—বিএনপি সরকারের আমলেও তারা তা করেনি। কারণ ছিল ভারতকে অখুশি না করা। আর তা হলে এটা বলাই বাহুল্য যে পরের আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে আইনটি স্বাক্ষর করার মতো মেরুদণ্ড থাকার কোনোই কারণ নেই। বাস্তবে তা-ই হয়েছে—বাংলাদেশ এখনো আইনটিতে স্বাক্ষর করেনি।
আবার ভারত যেহেতু এই আইনে স্বাক্ষর কখনোই করবে না, এটি মানা তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তারপরও বাংলাদেশ এই আইনে স্বাক্ষর করে থাকলে সে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে অন্তত আরজি পেশ করতে পারত।
তবে এটি ছাড়াও ডজনখানেক আইন আছে, যা পরোক্ষভাবে পানিবণ্টন বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন এক দেশ আরেক দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে, এমন কোনো স্থাপনা তৈরি করতে পারবে না ইত্যাদি। এর কয়েকটিতে বাংলাদেশ ও ভারত—উভয়েই স্বাক্ষর করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া সম্ভব।
দ্বিপক্ষীয় তথা অববাহিকাসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে চুক্তি বা সমঝোতা, যেমন যৌথ নদী কমিশন কতটা কাজ করছে? সারা বিশ্বে ১৯৯৭ সালের নদী আইন বলবৎ হওয়ার আগেও অনেক দেশ এ ধরনের কমিশন গঠন করে পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করেছে। এ ধরনের দুটি ভালো উদাহরণ হচ্ছে মেকং ও নাইল রিভার কমিশন। এই কমিশনগুলোতে একাধিক দেশ জড়িত। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনে যদি আরও দেশ তথা চীন, নেপাল ও ভুটানকে সঙ্গে রাখা যেত, তাহলে সম্ভবত এটি ভালো কাজ করত।
তবে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত পর্যালোচনা নাহয় আরেক দিন করা যাবে। সমরবিদ্যায় চতুর্থ জেনারেশনের যুদ্ধ বলে একটি কথা আছে। তা হচ্ছে একটি গুলিও খরচ না করে একটি দেশকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তাকে শোষণ করা। পানির মতো একটি অমূল্য সম্পদের নিয়ন্ত্রণ হাতে পেয়ে এত সহজে ভারত আপনাকে আপসে তা দিয়ে দেবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা অন্তত তা-ই বলে। সেই আলোকে এটা নিশ্চিত যে এ লাইনে তাই কোনো সমাধান বা অধিকার আদায়ের তেমন সম্ভাবনা নেই।
বাকি রইল দেশের ভেতরে স্থাপনা নির্মাণ করে বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখা। বাঁধ সে ধরনের একটি স্থাপনা।
বাংলাদেশে কোন ধরনের বাঁধ নির্মাণ সম্ভব
ড্যাম নির্মাণ করতে গেলে পাহাড় লাগবে। পশ্চিম আর উত্তরে পাহাড় বাংলাদেশে নেই। পাহাড়ের পর সমতল অংশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। সব পাহাড় ওপারে, পূর্বে কিছু আছে। কর্ণফুলীতে কাপ্তাই ড্যাম তেমনই একটি অঞ্চলে। ড্যাম নির্মাণ করা যেতে পারে সাঙ্গু বা মাতামুহুরীতেও।
তবে বেশি প্রয়োজন সুরমা, কুশিয়ারা বা এ অঞ্চলের আরও কিছু নদ-নদীর ওপরে। হ্যাঁ, এদিকে কিছু পাহাড় আছে এবং বড় আকারের না হলেও ছোট আকারে ড্যাম বা জলাধার নির্মাণ করা সম্ভব, যা এ অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ বিষয়ে কখনোই তেমন সিরিয়াস আলোচনা হতে দেখা যায়নি, সমীক্ষাও নেই।
তবে দুটি ব্যারাজ নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় অনেক দিন থেকেই, গঙ্গা আর তিস্তা ব্যারাজ। ফারাক্কা বাঁধের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই গঙ্গা বাঁধের পরিকল্পনা হচ্ছে সেই ষাটের দশক থেকে। প্রায় ১০ বছর আগেই চীন গঙ্গার ওপর বাংলাদেশ অংশে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল।
প্রারম্ভিক ডিজাইনও করা হয়েছিল, কিন্তু ভারতের হস্তক্ষেপে তা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত গঙ্গা বাঁধ দ্বিতীয় পদ্মা সেতু হিসেবে কাজ করত এবং এ থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব ছিল। মূল কারণ নতজানু পররাষ্ট্রনীতি।
এই দুটি ব্যারাজের ক্ষেত্রেই বিস্তারিত কারিগরি ও আর্থিক সম্ভাব্যতার সমীক্ষা আছে এবং দুটি ক্ষেত্রেই তা ফিজিবল বা বাস্তবসম্মত বলে প্রমাণিত। আপনি যদি বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি অধিক পরিমাণে ধরে রাখতে পারেন, তাহলে শুষ্ক মৌসুমে তা ব্যবহার করতে পারবেন। আবার অপেক্ষাকৃত সমতলে অবস্থিত গঙ্গা ব্যারাজের ওপরের অংশে দুই পাড়ে সুউচ্চ ‘এমব্যাংকমেন্ট’ বানিয়ে পেছনে ভারতকে বর্ষায় জলে ডোবানোর হুমকিও দিতে পারেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত কারিগরি ব্যাখ্যা অন্য দিন আলোচনা করা যাবে।
করণীয়
একজন পরিবেশবিশেষজ্ঞ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পানি উপদেষ্টা হয়েছেন। পরে কোনো সময় একটি নির্বাচিত সরকার আসবে। উভয় সরকারের কাছে কিছু দাবি: আন্তর্জাতিক নদী আইনটি স্বাক্ষর করুন। প্রয়োজনে আদালতে যান। লাভ হবে না, তবে নৈতিক সমর্থন পাবেন। যৌথ নদী কমিশনে নেপাল, ভুটান ও চীনকে সংযুক্ত করুন। গঙ্গা ও তিস্তা ব্যারাজ—এ দুটি প্রকল্পের অর্থসংস্থান নিশ্চিত করে যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন শুরু করুন।
সুরমা, কুশিয়ারাসহ পূর্বাঞ্চলের অনেক নদীর উজানে ড্যাম নির্মাণ সম্ভব কি না, তা যাচাই শুরু করুন। স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খননসহ ড্রেজিং কার্যক্রম বাড়ান।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের জীবন ও অর্থনীতির সঙ্গে পানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্রুগ কমিশন থেকে শুরু করে ‘ফ্যাপ’ কিংবা ‘ডেলটা প্ল্যান’—কোনো পানি পরিকল্পনাতেই বাংলাদেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক ও সময়োপযোগী তেমন কিছু করা সম্ভব হয়নি। অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো সমাধান। এবার রাষ্ট্র সংস্কারকদের কাছে দাবি থাকবে, তাঁরা যেন কারও রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষাকারী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
লেখক: অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম। সূত্র: প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ