বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুটি প্রতিবেদনেও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণের তথ্য দেয়া হয়েছে দুই ধরনের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ ও বিদেশী বিনিয়োগসংক্রান্ত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটার্নাল ডেবটে’ (জানুয়ারি-জুন, ২০২৩) দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট এফডিআই প্রবাহ দেখানো হয়েছে প্রায় ৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
আর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো নিয়ে গত মার্চে প্রকাশিত সর্বশেষ ‘মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস: মান্থলি আপডেট’ প্রতিবেদনে ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) অংশে নিট এফডিআই দেখানো হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত পদ্ধতিগত পার্থক্যের কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই প্রতিবেদনে নিট এফডিআইয়ের তথ্যে এ ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। একইভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়নেও বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি করছে পদ্ধতিগত ভিন্নতা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক রূপান্তরে প্রত্যক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এফডিআই। আশির দশক-পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে তা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অবদান রেখেছে। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে বড় প্রভাবকের ভূমিকা রাখে এফডিআই।
যদিও এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত প্রতিবেশী মিয়ানমারও বাংলাদেশের তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের দিক থেকে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশে নিট এফডিআই জিডিপির ১ শতাংশেরও কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এফডিআই ও বিদেশী ঋণসংক্রান্ত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩২৪ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ইকুইটি মূলধন ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলার, পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় ২৩৭ কোটি ৫ লাখ ডলার ও আন্তঃকোম্পানি ঋণ ৮ কোটি ৩২ লাখ ডলার।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের নিট এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এর মধ্যে ইকুইটি মূলধন ১৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় ২০৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার ও আন্তঃকোম্পানি ঋণ ৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। মূলত ইকুইটি মূলধন কমে যাওয়ার কারণেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর আগের বছরের তুলনায় দেশে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে। ইকুইটি মূলধন কমে যাওয়ার অর্থ হলো দেশে নতুন বিনিয়োগ আসছে না।
এ প্রতিবেদনে নিট এফডিআই হিসাব করা হয়েছে মোট এফডিআই (গ্রস) থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের পরিমাণকে বাদ দিয়ে। গত অর্থবছরে দেশে গ্রস এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ৪৪২ কোটি ৮১ লাখ ডলার। এ সময়ে মূলধন প্রত্যাবাসন, বিপরীতমুখী বিনিয়োগ, মূল কোম্পানিকে প্রদত্ত ঋণ ও আন্তঃকোম্পানি ঋণ পরিশোধ বাবদ ১১৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ হিসাবের ভিত্তিতে দেশে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২৪ কোটি ৯৭ লাখ ডলার।
অন্যদিকে প্রধান অর্থনৈতিক সূচকগুলো নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্চে প্রকাশিত সর্বশেষ মাসভিত্তিক প্রতিবেদনের বিওপি বা লেনদেন ভারসাম্যের অংশে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ১৬৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ১৮২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ দুই প্রতিবেদনে নিট এফডিআইয়ের তথ্যের মধ্যে ব্যবধান বেশ বড়। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের নিট এফডিআইয়ের তথ্যে ১৬০ কোটি ৬ লাখ ডলার ও ২০২১-২২ অর্থবছরের নিট এফডিআইয়ের তথ্যে ১৬১ কোটি ২৬ লাখ ডলারের পার্থক্য রয়েছে। মার্চের মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস: মান্থলি আপডেট প্রতিবেদনের বিওপি অংশের নোটে নিট এফডিআই হিসাবায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের (ডিসইনভেস্টমেন্ট) পাশাপাশি ঋণ পরিশোধ ও ক্ষতি বাদ দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পদ্ধতিগত ভিন্নতার কারণেই দুই প্রতিবেদনে নিট এফডিআইয়ের তথ্যের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। বিওপিতে নিট এফডিআই হিসাব করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে দেশের বিভিন্ন আর্থিক সূচকের যেসব তথ্য পাঠানো হয়ে থাকে, সেখানেও নিট এফডিআইয়ের এ তথ্যটিই ব্যবহার করা হয়। নিট এফডিআইয়ের এ তথ্যটিই বেশি গ্রহণযোগ্য।’
বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হকের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বিপাকে ২০২২ সালের প্রথমার্ধেই সংকটের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। এফডিআই প্রবাহও এ সময় হয়ে ওঠে নিম্নমুখী। পাশাপাশি ঘটতে থাকে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘটনা। কমে যায় বিদেশী বিনিয়োগের পুঞ্জীভূত পরিমাণও (এফডিআই স্টক)। এর আগে গত দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে এফডিআই স্টক ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে ওই ধারাবাহিকতা হারিয়ে এফডিআই প্রবাহে দেখা যাচ্ছে ছন্দপতন।
২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ওষুধ খাতের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সানোফি। প্রতিষ্ঠানটির প্রত্যাহারকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় অর্ধসহস্র কোটি টাকা। একইভাবে প্রায় এক যুগ ব্যবসা করার পর স্থানীয় প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কাছে নিজ মালিকানার সব শেয়ার বিক্রি করে দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি জুলফার গালফ ফার্মাসিউটিক্যালস, অর্থের অংকে যার পরিমাণ আনুমানিক দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ব্যবসারত বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার সংকটের কারণে তাদের প্রধান কার্যালয়ে লভ্যাংশ, রয়্যালটি ফিসহ অর্থ পাঠাতে সমস্যায় পড়েছে। মার্কিন কোম্পানি শেভরনের অর্থ আটকে থাকায় বিষয়টি নিয়ে দেশটির রাষ্ট্রদূতকেও তৎপর হয়ে উঠতে দেখা গেছে। এছাড়া নিজ নিজ দেশের কোম্পানিগুলোর অর্থ ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দেনদরবার করতে দেখা গেছে আরো বেশকিছু দেশের রাষ্ট্রদূতকেও।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পদ্ধতিগত পার্থক্যের কারণেই দুই ধরনের নিট এফডিআইয়ের তথ্য দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিওপিতে থাকা নিট এফডিআইয়ের তথ্যটিই দেশের প্রকৃত এফডিআই। প্রশ্ন হচ্ছে এত প্রণোদনা দেয়ার পরও গত ১৫ বছরে দেশে এফডিআইয়ের পরিমাণ বাড়েনি। এটি এখনো জিডিপির ১ শতাংশের কম। দেশে যে এফডিআই আসছে, বড় একটি অংশ মূলত পুনর্বিনিয়োগকৃত আয়।
অর্থাৎ বিদেশী কোম্পানিগুলো এখানে ব্যবসা করে যে লাভ করেছে, সেটিই পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন অর্থের প্রবাহ সেভাবে আসেনি। যে এফডিআই আসছে তা পরিমাণে কম ও গুণগতমানে খুবই নিচুস্তরের। অথচ ভিয়েতনাম কীভাবে ৮ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে, বর্তমান অবস্থায়ও মিয়ানমারও কীভাবে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি এফডিআই পেয়েছে, আমাদের প্রেক্ষাপটে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য, নতুন প্রযুক্তি আনার কথা বলে আমরা বিদেশী ঋণ এনে থাকি। এগুলো কতখানি হয়েছে আমরা নিশ্চিত নই। ডলার সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মুনাফা বিদেশ নিতে পারছে না। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা তাদের কোম্পানির টাকা নিজ দেশে পাঠানোর জন্য চেষ্টা করছেন। জ্বালানি খাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির সবচেয়ে বেশি টাকা আটকে আছে। যে দেশ থেকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো উপার্জিত অর্থ নিজ দেশে নিতে পারে না, সে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা খুবই সংকীর্ণ।’
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসভিত্তিক প্রতিবেদনের বিওপির অংশে উঠে আসা নিট এফডিআইয়ের পরিসংখ্যান ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিবেদনে একই সময়ের জন্য নিট এফডিআইয়ের যে তথ্য দেয়া হচ্ছে, সেখানে সময়ের ব্যবধানে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু এত বড় পার্থক্যের বিষয়ে অন্তত একটি ব্যাখ্যা তো থাকা উচিত। একই প্রতিষ্ঠানের একই তথ্যের মধ্যে যদি এত বেশি পার্থক্য থাকে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য তথ্য নিয়েও তো মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে।’
গত কয়েক বছর ধরেই দেশের নিট এফডিআই প্রবাহ নিম্নমুখী। বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে নিট এফডিআই সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১৩৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছিল। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশের নিট এফডিআই দাঁড়িয়েছে ১১১ কোটি ৮০ লাখ ডলারে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সে অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দেশে নিট এফডিআইয়ের প্রবাহ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) ত্রৈমাসিক বুলেটিনে বলা হয়, রফতানি আয় বাড়ানো ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার অন্যতম প্রধান উপাদান এফডিআই। অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রবর্তন ও অন্যান্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এফডিআই আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পর ভিয়েতনাম চতুর্থ স্থানে রয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের এফডিআই আকর্ষণের জন্য ভিয়েতনামের কৌশল পর্যালোচনা করা উচিত বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠন দ্য ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) প্রেসিডেন্ট এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আখতার বলেন, ‘নিট এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের তথ্যগত পার্থক্য থাকা উচিত নয়। আমাদের এখানে রফতানির ক্ষেত্রেও এ ধরনের তথ্যগত পার্থক্য প্রতি বছরই দেখা যায়। বাংলাদেশ প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের তুলনায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত বড় ধরনের নীতি সংস্কার করার পর ব্যাপকভাবে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের এখানেও কর কাঠামো, নীতির ধারাবাহিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার মতো বিষয়গুলোয় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। যতদিন পর্যন্ত এক্ষেত্রে সংস্কার না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এফডিআই আকর্ষণ করা সম্ভব হবে না।
বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) ও রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) স্থাপন করা হয়েছে। যদিও এসব অঞ্চলের বাইরে থেকেই বিনিয়োগ বেশি আসছে। গত অর্থবছরে দেশে আসা নিট এফডিআই প্রবাহের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ বা ২৮৩ কোটি ৯১ লাখ ডলার এসেছে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ ও অর্থনৈতিক অঞ্চলবহির্ভূত এলাকায়। গত অর্থবছর বেজায় নিট এফডিআই ছিল মাত্র ৪১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। আর রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে এফডিআই প্রবাহ ছিল ৪০ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার ডলারের।
গত অর্থবছরে দেশের উৎপাদন খাতে (বস্ত্র ও পোশাক, খাদ্য ও চামড়া) সবচেয়ে বেশি ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ নিট এফডিআই এসেছে। এরপর সবচেয়ে বেশি ২১ দশমিক ৩ শতাংশ এফডিআই এসেছে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি খাতে। ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ এফডিআই এসেছে পরিবহন, স্টোরেজ ও যোগাযোগ খাতে। ট্রেড ও কমার্স (ব্যাংক ও ট্রেডিং) খাতে এসেছে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ এফডিআই। গত অর্থবছরে সেবা খাতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এফডিআই এসেছে।
বাংলাদেশে গত অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকে সবচেয়ে বেশি ৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। এছাড়া নেদারল্যান্ডস থেকে ৪২ কোটি ৫৯ লাখ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২৯ কোটি ৫৩ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৮ কোটি ৯২ লাখ, সিঙ্গাপুর থেকে ১৯ কোটি ২১ লাখ, নরওয়ে থেকে ১৮ কোটি ৪০ লাখ, হংকং থেকে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ, মাল্টা থেকে ১৭ কোটি ১০ লাখ, ভারত থেকে ১১ কোটি ৯৯ লাখ এবং মালয়েশিয়া থেকে ৯ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুর থেকে এফডিআইয়ের পরিমাণ কমেছে।
দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ করছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সংস্থাটির নির্বাহী সদস্য (স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট) অতিরিক্ত সচিব অভিজিত চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রকৃত বিনিয়োগের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন খাতের বিনিয়োগ সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহের তথ্যের পার্থক্য বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। যথাযথভাবে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করা সম্ভব হয় না, যা বিনিয়োগ বিকাশের প্রচারণায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহের প্রকৃত ও গ্রহণযোগ্য তথ্যসূত্র আমাদের কাছে নেই। কাজেই বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহের তথ্যে বিভ্রান্তিকর কিছু থাকলে তা দূর করা প্রয়োজন।’
নিট এফডিআইয়ের মতো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনার ক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত ভিন্নতা রয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদ্ধতি অনুসারে গণনা করা রিজার্ভের অংকে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে আইএমএফের সদস্য দেশগুলো ব্যালান্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তা শুরু করতে সময় নিয়েছে প্রায় এক যুগ। মূলত আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির শর্তানুসারে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস তথা গত বছরের জুলাই থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে ২০২২ সালের জুন শেষে বিপিএম৬ অনুসারে দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে যা ৪১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের জুন শেষে বিপিএম৬ অনুসারে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল বিপিএম৬ পদ্ধতিতে দেশের গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে তা ছিল ২৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী হিসাব করা রিজার্ভও বাংলাদেশের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ নয়। নিট রিজার্ভ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে নেয়া এসডিআরসহ স্বল্পমেয়াদি বেশকিছু দায় বাদ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে নিট রিজার্ভ ও গ্রস রিজার্ভের মধ্যে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো পার্থক্য থাকে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হয় না।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিওপিতে থাকা নিট এফডিআইয়ের তথ্য যদি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে হিসাব করা হয়ে থাকে তাহলে অন্য প্রতিবেদনে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ বেশি দেখানো হচ্ছে কেন? এটি আমার কাছে বোধগম্য নয়।’
আপনার মতামত জানানঃ