লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি তরুণ নিহত হয়েছেন।
আজ শুক্রবার ভোরে পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ঝালঙ্গী ডাঙ্গারপাড় সীমান্তের ৮৪৮ পিলারের কাছে এ ঘটনা ঘটে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি জানান, পুলিশ ইতোমধ্যে নিহতের মরদেহ উদ্ধার করেছে।
নিহত তরুণের নাম আবুল কালাম (২২)। তিনি পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ঝালঙ্গী ডাঙ্গারপাড় গ্রামের মৃত অপির উদ্দিনের ছেলে।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি), পুলিশ ও নিহতের পরিবারের লোকজন ডেইলি স্টারকে জানান, আজ সকালে সীমান্তে গরু আনতে গেলে বিএসএফের সদস্যরা গুলি চালায়। পরে আহত অবস্থায় কালামকে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান।
তিস্তা ৬১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের ঝালঙ্গী ক্যাম্পের ইনচার্জ নায়েক সুবেদার নুরুল আমিন ডেইলি স্টারকে জানান, এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে শুক্রবার সকালে বিএসএফকে পত্র দেওয়া হয়েছে। বিএসএফকে দেওয়া পত্রে পতাকা বৈঠকের আহবান করা হয়েছে।
ওসি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শুধু বিএসএফের সরাসরি গুলিতে নিহত হয়েছে ২২ বাংলাদেশি। আহত হয়েছে ২০ জনের বেশি। গুলি ছাড়াও এ সময়ে সীমান্তে ঘটেছে আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।
বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, সীমান্তে হত্যা কখনোই থামেনি। বরং কোনো কোনো বছর এই সংখ্যা ছাড়িয়েছিল চল্লিশের ঘর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিএসএফের গুলি, নির্যাতন ও ধাওয়ায় ২৩ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। ২০২১ সালে বিএসএফের হাতে গুলিসহ বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়েছিল ২০ জন। ২০২০ সালে গুলি ও নির্যাতনে হত্যার ঘটনা ঘটে ৪৮টি। ২০১৯ সালে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ৪৬ জন নিহত হয়। ২০১৮ সালে বিএসএফর গুলিতে নিহত হয় ৮ জন এবং নির্যাতনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ জন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ জন।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে এক প্রতিবেদনে সীমান্তে গুলি থেকে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ ছিল, বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আত্মরক্ষার প্রয়োজনে প্রথমে সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছুড়তে হবে। যদি এতে হামলাকারী নিবৃত না হয় এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে গুলি ছোড়া যাবে, তবে সেটা হতে হবে অবশ্যই হাঁটুর নিচের অংশে।
কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কাই যেন নেই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। ফেলানী হত্যার দৃশ্যই কি মনে করিয়ে দেয় না, বিএসএফ গুলি ছোড়ে স্রেফ হত্যার উদ্দেশ্যেই। বিএসএফ কোনো ক্ষেত্রেই প্রমাণ করতে পারেনি যে, হতাহতের শিকার মানুষগুলোর মাধ্যমে তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি ছিল।
সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার অন্যতম প্রধান কারণ দেশটির সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। এ ছাড়াও দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। এখানকার একশ্রেণির মানুষ কৃষি ও অন্যান্য পেশার পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত গবাদি পশু ও পণ্য পাচারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এই হত্যার শিকার অধিকাংশই বিভিন্ন চোরাচালান কর্মের সঙ্গে জড়িত বলেই অভিযোগ বিএসএফের।
কিন্তু দুই দেশের আইন অনুযায়ী, কেউ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করলে, কাঁটাতার কাটলে বা পাচারের চেষ্টা করলে তাদের গ্রেপ্তার করে ওই দেশের আইনানুযায়ী বিচার করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোড়া বা নির্যাতন করা যাবে না।
সীমান্তে হত্যা নিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কিছু কথা হয়েছিল। কেউ যদি দেশের সীমানা অবৈধভাবে পার হওয়ার চেষ্টা করে, ভারতের প্রতিনিধি জানতে চেয়েছিলেন, তখন আমাদের কী করণীয়। এদের ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ যদি নিতেই হয়, তখন বলা হয়েছিল দুই পক্ষই রাবার বুলেট ব্যবহার করবে। কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। যাতে করে হত্যাকাণ্ড কমানো যায়।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার কমানো খুবই মুশকিল বলে মনে করি। এটা যদি থামাতে হয়, তবে আমাদের কিছু মানবিক উপায় বের করতে হবে, যার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ঘটবে না। হত্যাকাণ্ড আমরা সমর্থন করতে পারি না। অন্যদিকে দুই পক্ষেরই সীমান্তে চোরাচালান থামানো প্রয়োজন। দুই দেশের মধ্যে সচিব পর্যায়ে যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে আমাদেরও মতামত দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার বিষয়ে আমরা বলেছিলাম। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বিধায়, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ফলে প্রতিনিয়তই এমন হত্যা দেখছি।
যতদিন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সুষ্ঠু বাণিজ্য চুক্তি না হবে, যতদিন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া সহজতর না হবে, ততদিন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনাগুলো বোধহয় ঘটতেই থাকবে। অন্যান্য দেশে এমনটা হয় না। কারণ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া অনেক সহজ। তবে চোরাচালান বন্ধ হোক, এটা আমরাও চাই। এর জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আমাদের চিন্তা করতে হবে, যার মাধ্যমে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটবে না।
আপনার মতামত জানানঃ