দশম শতকে খৃষ্টান আর মুসলমানদের মধ্যে ধর্মের নামে তিনশো বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল, যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল পুরো ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকার বহু দেশ। দশম শতকে জেরুসালেমসহ প্রাচীন ফিলিস্তিনের (বর্তমানে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্ডানের অংশ) এমন কিছু জায়গাকে পবিত্র ভূমি বলে মনে করা হতো, যা ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং মুসলমান- তিন ধর্মের মানুষের কাছে ছিল তীর্থস্থান।
সেই সময় জেরুসালেমসহ এসব পবিত্রভূমি ছিল মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া স্পেন, উত্তর আফ্রিকা এবং এশিয়া মাইনরে (আধুনিক তুরস্কের যে অংশটি এশিয়ায় পড়েছে) ছিল মুসলমানদের আধিপত্য। জেরুসালেম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়া আর মুসলমানদের আধিপত্য ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই মূলত শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টান আর মুসলমানদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ। খ্রিষ্টানরা যাকে ক্রুসেড বলে বর্ণনা করেন। মুসলমানরা অনেক সময় একে জিহাদ বলে অভিহিত করেছেন। পরের তিনশো বছর ধরে খ্রিষ্টানদের ক্রুসেড চলেছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ড. সোনিয়া নিশাত আমিন মনে করেন, ক্রুসেডের পেছনে ধর্ম ছাড়াও আরও অনেকগুলো উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বলছেন, ”ধর্মের কথা বলা হলেও এখানে শুধু ধর্ম একমাত্র বিষয় ছিল না। তিন চার শতাব্দী ধরে যেটা চলমান ছিল, তার পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। খ্রিষ্টান এবং মুসলমান- দুটি ধর্মের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই থেকেই ক্রুসেডের শুরু।
কিন্তু ক্লেরমন্টে পোপ দ্বিতীয় আরবান যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, যেখান থেকে ক্রুসেডের সূত্রপাত হয়, তা থেকে বোঝা যায়, এর পেছনে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অর্থনৈতিক কারণও ছিল।” ”এর পেছনে ব্যবসা বাণিজ্য, ভূমির জন্য ক্ষুধা, ক্ষমতার বিস্তার, নিজেদের সাম্রাজ্য বা প্রভাব ধরে রাখা, অনেকগুলো কারণ ছিল,” তিনি বলছেন।
মধ্যযুগে খ্রিষ্টানদের কাছে জেরুসালেম শহরটি ছিল তাদের ধর্মীয় প্রেরণার প্রধান কেন্দ্র। কারণ এখানেই যিশু খৃষ্টের মৃত্যু হয়েছিল এবং সমাহিত করা হয়েছিল। জেরুসালেমে থাকা চার্চ অফ দি হোলি সেপালকরে শত শত বছর ধরে খ্রিষ্টান তীর্থযাত্রীরা আসতেন। অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে জেরুসালেম তৃতীয় পবিত্র নগরী, যেখান থেকে ইসলামের নবী মোহাম্মদ বেহেস্তে যাত্রা করেছিলেন বলে ইসলাম ধর্মের বিবরণে উল্লেখ করা হয়।
ছয়শ আটত্রিশ সালে আরব মুসলমানরা এই শহর ও পবিত্র এলাকা বলে বিবেচিত ভূমি দখল করে নেয়। এই শহরের ডোম অফ দ্যা রক এবং আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের কাছে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় স্থান। মুসলমানরা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরেও খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীরা বিনা বাধায় তাদের তীর্থকেন্দ্রে আসতে পারতেন। কিন্তু প্রায় ১০৭৭ সালে সেলযুক শাসকরা তাতে কড়াকড়ি আরোপ করে। সেই সময় অনেক স্থানে খ্রিষ্টান তীর্থযাত্রীরা হয়রানির শিকার হন বলেও খবর ছড়িয়ে পড়ে।
তখন বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম আলেক্সিস কমনেনুস ভয় পেতে শুরু করেন যে, সেলযুক সাম্রাজ্য তার এলাকার দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কনস্টান্টিনোপলের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। সেটা ঠেকাতে তিনি পোপের সহায়তা চান।
দি অথোরিটেটিভ হিস্টরি অফ দ্য ওয়ার ফর দ্য হোলি ল্যান্ড’ গ্রন্থে থমাস অ্যাসব্রিজ উল্লেখ করেছেন, সম্রাটের অনুরোধের পর ১০৯৫ সালে ফ্রান্সের একটি ছোট্ট শহর ক্লেরমন্টে পোপ দ্বিতীয় আরবান ঘোষণা দেন, খ্রিষ্টান ধর্ম বিপদে রয়েছে, হামলা ও আগ্রাসনের মুখে পড়েছে। যিশুর সৈনিক হিসাবে ইউরোপকে জেগে ওঠার আহ্বান জানান। ইউরোপের যোদ্ধারা যদি খ্রিষ্টান ধর্মের জন্য জেরুসালেম উদ্ধারে যুদ্ধ করতে যায়, তাহলে তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
ফলে ইউরোপের যোদ্ধাদের পাশাপাশি বহু সাধারণ মানুষও অস্ত্র হাতে ক্রুসেডার দলে যোগ দেন। তাদের প্রতীক ছিল লাল রঙের ক্রস চিহ্ন। প্রথম ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ শুরু হয় ১০৯৬ সালে। ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইতালি থেকে ক্রুসেডাররা (যাদের আরবরা ডাকতো ফ্রাঙ্কস নামে) পবিত্র ভূমি উদ্ধারের জন্য রওনা দেন। প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা কনস্টান্টিনোপলে সমবেত হয়।
কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট আলেক্সিস ক্রুসেডার সমর নায়কদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন, তারা যেসব এলাকা দখল করবেন, তা তার সাম্রাজ্যের অংশ হবে। প্রথমে পিপলস ক্রুসেড নামে সাধারণ যোদ্ধাদের একটি দল বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করে মুসলমানদের আক্রমণ করলেও তুর্কি বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়।
থমাস অ্যাসব্রিজ লিখেছেন, প্রায় ৭৫ হাজার ক্রুসেডারের এই বাহিনী সেলযুক রাজধানী নিকায়া দখল করে। এরপর দরিলিয়ামের যুদ্ধে মুসলমান বাহিনীকে ঠেকিয়ে দেয়। ফলে তাদের জেরুসালেমের দিকে যাওয়ার পথ পরিষ্কার হয়। এরপর তারা এডেসা এবং অ্যান্টিওচ দখল করে। এরপর ক্রুসেডাররা জেরুসালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেই সময় জেরুসালেমের গভর্নর ছিলেন ফাতিমিদ শাসক ইফতিখার আদ-দুলা। তখন সেখানে সহস্রাধিক সৈনিক আর চারশো অশ্বারোহী ছিল বলে ধারণা করা হয়।
দি অথোরিটেটিভ হিস্টরি অফ দ্য ওয়ার ফর দ্য হোলি ল্যান্ড’ বইতে থমাস অ্যাসব্রিজ লিখেছেন, ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই দীর্ঘ অবরোধের পর তারা জেরুসালেম দখল করে। খ্রিষ্টানরা সেখানে নিষ্ঠুর আক্রমণ চালিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। সেই সময় তাদের একজনের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, ”এতো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল যে, আমাদের লোকজনের পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তে ভরে গিয়েছিল।” সেখানে সিনাগগে যে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা লুকিয়ে ছিলেন, তাদেরও হত্যা করে ক্রুসেডাররা।
তেরশ শতকে ইরাকি ইতিহাসবিদ ইবন আল-আথিরের মতে, সেই সময় জেরুসালেমে ৭০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় ধারণা করা হয়, সেই সময় নিহতের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি ছিল না। জেরুসালেম দখল করার পর সেটি ঘিরে একটি রাজত্ব স্থাপন করে ক্রুসেডাররা। যার মধ্যে ছিল ফিলিস্তিনের বড় একটি অংশ। শহর দল করার পরে ক্রুসেডারদের অনেকে তাদের বাড়িঘরে ফিরে যান।
জেরুসালেম হাতছাড়া হয়ে যাওয়া মুসলমানদের জন্য ছিল বড় একটি আঘাত। ফলে মুসলমানরাও সংগঠিত হতে শুরু করে। এগারোশ ত্রিশ সাল থেকে ‘ফাঙ্কস’দের বিরুদ্ধে মুসলমানরা তাদের ‘জিহাদ’ বা ধর্মযুদ্ধ শুরু করে। এগারোশ চুয়াল্লিশ সালে মসুলের গভর্নর সেলযুক জেনারেল যাঙ্গির নেতৃত্বে মুসলমানরা এডেসা আবার দখল করে নেয়। এই খবর ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর খ্রিষ্টানরা দ্বিতীয় ক্রুসেডের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ফ্রান্সের রাজা সপ্তম লুইস এবং জার্মানির রাজা তৃতীয় কনরাডের নেতৃত্বে দুটি বাহিনী ১১৪৭ সালে এশিয়া মাইনর বা এখনকার তুরস্কের যে অংশটি এশিয়ায় পড়েছে সেখানে প্রবেশ করে।
কিন্তু যে স্থানে প্রথম ক্রুসেডের সময় প্রথম মুসলমান বাহিনীকে পরাজিত করেছিল ক্রুসেডাররা, সেই দরিলায়ামে মুসলমান বাহিনীর হাতে রাজা তৃতীয় কনরাডের বাহিনী পরাজিত হয়। রাজা লুইস এবং কনরাডের বাহিনী এরপর জেরুসালেমে সমবেত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, সিরিয়ার শক্ত ঘাঁটি, দামেস্কে আক্রমণ করবে। তখন সাহায্যের জন্য যাঙ্গির উত্তরসূরি নূর আল-দ্বীনের সহায়তা চান দামেস্কের শাসক। মুসলমানদের যৌথ বাহিনীর কাছে শোচনীয় পরাজয় হয় ক্রুসেডার বাহিনীর।
এরপর নূর আল-দ্বীনের সেনাপতি শিরকুহ এবং তার ভাইপো সালাহউদ্দিন কায়রো থেকেও ক্রুসেডার বাহিনীকে বিতাড়িত করে। শিরকুহের মৃত্যুর পর সেনাপ্রধান হন সালাহউদ্দিন। সুলতান নূর আল-দ্বীনের মৃত্যুর পর নিজের ক্ষমতা সংহত করে আয়ুবিদ রাজবংশ পত্তন করে সালাহউদ্দিন। এগারোশ ছিয়াশি সালে রেমন্ড অফ চ্যাবলিয়ন কায়রো থেকে দামেস্কগামী মুসলিম একটি বহরকে আক্রমণ করলে জেরুসালেমের পথে রওনা হন সালাহউদ্দিন। থমাস অ্যাসব্রিজ তার বইতে লিখেছেন, ১১৮৭ সালে হাত্তিমের যুদ্ধে খ্রিষ্টান বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন সালাহউদ্দিন। এরপর তিনি জেরুসালেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
এর ফলে শুরু হয় তৃতীয় ক্রুসেড। জেরুসালেম পুনরুদ্ধারের জন্য তখনকার পোপ অষ্টম গ্রেগরি তৃতীয় ক্রুসেডের ঘোষণা দেন। সম্রাট ফ্রেডারিক বারবারোসা (সিরিয়ায় পৌঁছানোর পূর্বে সলিল সমাধি হয়), ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এবং ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম রিচার্ড (রিচার্ড দ্যা লায়নহার্ট নামে পরিচিত) নেতৃত্বে ক্রুসেডাররা জেরুসালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
এগারোশ একানব্বই সালের সেপ্টেম্বরে রাজা রিচার্ডের বাহিনী আরসুফের যুদ্ধে সালাহউদ্দিনের বাহিনীকে পরাজিত করে। এরপর তিনি জেরুসালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হন, কিন্তু শহর অবরোধ করতে রাজি হননি। এগারোশ বিরানব্বই সালে রিচার্ড এবং সালাহউদ্দিনের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি হয়। এর ফলে জেরুসালেম শহরের নিয়ন্ত্রণ মুসলমানদের হাতে থাকলেও, আশেপাশের এলাকায় কিংডম অব জেরুসালেম পুনরায় প্রতিষ্ঠা হয়। এর মাধ্যমে অবসান হয় তৃতীয় ক্রুসেডের।
ইতিহাসবিদদের মতে, এরপর আরও অন্ততও বেশ কয়েকটি ক্রুসেড হয়েছে। কিন্তু সেগুলো এতো বড় মাত্রার ছিল না। বরং তখন শুধুমাত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই না হলে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ শুরু হয়। যেমন চতুর্থ ক্রুসেড হয়েছি অষ্টম বাইজেন্টাইন সম্রাটের বিরুদ্ধে। কারণ তার ভাইপো চতুর্থ আলেক্সিসকে ক্ষমতায় বসাতে ওই ক্রুসেড ঘোষণা করেছিলেন পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট।
আবার তেরশ শতকে ফ্রান্সের কাথারি বা আলবাইজেনসিনিয়ান গোত্রকে নির্মূল করতে একটি ক্রুসেড হয়েছে। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সোনিয়া নিশাত আমিন বলছেন, ”ক্রুসেডে কে জিতেছে, কে হেরেছে, সেটার সহজ উত্তর নেই। তবে পাশ্চাত্য সেখানে গিয়ে পুরো সফল হতে পারেনি। মুসলিম সাম্রাজ্য সেখানে আস্তে আস্তে আরও সংহত হয়েছে। হোলি ল্যান্ড নিয়ে যেসব দাবি ছিল, তিনশো বছরের যুদ্ধে উভয়পক্ষ হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে, এখানে ইতি টানা দরকার।”
সর্বশেষ যখন ১২৯১ সালে ক্রুসেডারদের সর্বশেষ নিয়ন্ত্রিত শহর আর্ক মামলুকদের দখলে চলে যায়, এর মধ্য দিয়ে ক্রুসেডারদের শাসনও শেষ হয়ে যায়। সূত্র: বিবিসি।
আপনার মতামত জানানঃ