২০১৬ সালের কথা। গুজরাটের (Gujarat) কচ্ছ অঞ্চলের খাতিয়া (Khatiya) গ্রামের থেকে ৩০০ মিটার দূরে একটি স্থান পর্যবেক্ষণ করছিলেন কেরালা বিশ্বদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একদল পড়ুয়া। গ্রামের প্রধানের মতে, এই অঞ্চলটি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন তারা। এমনিতে শুকনো জায়গা, তবে মাঝেমধ্যে বৃষ্টিপাত হলে মাটি থেকে উঠে আসে বিভিন্ন আকারের পাত্র। এখানে নাকি ভূতের বাস! কিন্তু ভূতগুলি কাদের সেটাও তো জানা দরকার।
২০১৯ সালে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা শুরু করেন খননকার্য। হ্যাঁ, সত্যিকারেই ‘ভূত’ আছে এখানে। এই ‘ভূত’ বহন করছে প্রাচীন এক ইতিহাসের সাক্ষ্য। খননকার্যে পাওয়া গেছে মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা কয়েক হাজার পুরনো সিন্ধু সভ্যতার কয়েকশো কবর। যার ফলে বিস্ময়ের সঙ্গে অসংখ্য প্রশ্নের অজানা উত্তর ভাবিয়ে তুলেছে বিজ্ঞানীদের।
পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে খুব দূরে নয় জায়গাটি। মূলত বেলেমাটিতে ঢাকা। ২০১৯-এ ১৫০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী প্রায় ৪০ একর জায়গা জুড়ে খননকার্য শুরু করার সময় বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে পারেননি কী চমক লুকিয়ে আছে তাঁদের জন্য।
প্রাথমিকভাবে মাটির তলায় বেলেপাথরের কয়েকটি কাঠামো দেখে তাঁরা ভেবেছিলেন, হয়তো পুরনো কোনো শহরের ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু তারপরেই খুলে যায় রহস্যের খাসমহল। আবিষ্কৃত হয় একটা নয়, দুটো নয়, একেবারে পাঁচশো কবর। এখনও পর্যন্ত অবশ্য দুশোটি কবরের যথার্থ পুনরুদ্ধারের কাজ সম্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের অনুমান, খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সাল পর্যন্ত পাঁচশো বছর নিয়মিতভাবে কবর দেওয়া হয়েছে এই অঞ্চলে। তাহলে কি সাড়ে পাঁচ হাজার প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার (Harappan Civilization) বিস্তার ছিল এই অঞ্চল জুড়ে? গত একশো বছরে এখনও পর্যন্ত প্রায় ২০০০টি জায়গায় হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে গুজরাটের পশ্চিমে এই অঞ্চলের বিশেষত্ব আলাদা। পৃথিবীতে এত প্রাচীন ও এত বৃহৎ ‘শহুরে’ সভ্যতার কবরস্থান পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত।
প্রাচীন মিশর কিংবা মেসোপটেমিয়া সভ্যতাতেও মৃতদেহ সৎকার করা হত কবর দিয়ে। সেরকম বহু কবরস্থানের সন্ধান আছে বিজ্ঞানের কাছে। তবে খাতিয়ার সঙ্গে সেগুলির পার্থক্য বিস্তর। অস্ত্রশস্ত্র, দামি গয়না কিংবা ব্যবহার্য বিভিন্ন সামগ্রীতে ভরিয়ে দেওয়া থাকত তাদের সমাধি। কিন্তু এখানে শুধুমাত্র কাপড় মুড়িয়ে আয়তাকার বাক্সে শুইয়ে রাখা হত মৃতদেহদের। বড়োজোর রাখা ছিল কিছু মাটির পাত্র কিংবা তামার অলংকার।
কয়েকটি কবরে মিলেছে হাতের বালা, আয়না, তাবিজ, পুথির মালা ইত্যাদি। একশোটিরও বেশি চুড়ি, থালা-বাসন-হাঁড়ি, ঝিনুকের খোলের গয়না পাওয়া গেছে এখান থেকে। শিশুদের জন্য ব্যবস্থা ছিল পৃথক ছোটো কবরের। বয়স্কদের কবরে নৈবেদ্যরূপে দেওয়া থাকত খাবারদাবার। তবে বেশিরভাগ কঙ্কালই গলে মিশে গেছে মাটিতে। ফলে কয়েকটি পুরুষদেহের কঙ্কাল, কয়েকটি হাড়-দাঁত ছাড়া হরপ্পা সভ্যতার মৃতব্যক্তির প্রত্যক্ষ সন্ধান মেলেনি এখনও।
স্বাভাবিকভাবেই উঠছে অসংখ্য প্রশ্ন। পাঁচশো বছর তো নেহাৎ কম সময় নয়। তাহলে কি এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল কোনো নগরসভ্যতা? উড়িয়ে দেওয়া যায় না আশেপাশে আরো কোনো কবরস্থান থাকার সম্ভাবনাও। কিংবা মোট কবরের সংখ্যা হতে পারে পাঁচশোর বেশি। তবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এখনও কোনো জনবসতির খোঁজ মেলেনি। তার সঙ্গে আরো কিছু বিষয় বিস্মিত করেছে বিজ্ঞানীদের।
যেভাবে কবরের কাঠামো নির্মিত হয়েছে, তা নিখুঁত হাতের কাজ। অর্থাৎ এই পদ্ধতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত ছিল সেই সময়ের মানুষ। সেক্ষেত্রে আশেপাশের অঞ্চলে এই ধরনের পাথর থাকা অবশ্যই উচিত। সেই আশাতেই জারি রয়েছে খননকার্য। আপাতত ডিএনএ স্যাম্পেল ও অন্যান্য রাসায়নিক পরীক্ষায় চলছে বিস্তারিত তথ্য উদ্ধারের কাজ।
এখনও যেমন সিন্ধু সভ্যতার লিপি পাঠোদ্ধারের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি, তেমনই অসংখ্য রহস্য জড়িয়ে এই কবরস্থানের সঙ্গে। আগামী শীতে খাতিয়ার কাছে অন্য একটি অঞ্চলে শুরু হবে নতুন খননকার্য। আশা করা যায়, বহু প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে থাকবে সেই অভিযানে।
আপনার মতামত জানানঃ