র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) জবাবদিহিতা ও সংস্কারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ মনোযোগী। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নবম বার্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা এ তথ্য জানিয়েছেন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল সকালে অনুষ্ঠিত সংলাপে বাংলাদেশের নেতৃত্বে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা উইংয়ের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক ব্যুরোর আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ক উপসহকারী সেক্রেটারি মিরা রেসনিক।
সংলাপের পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গেও মিরা রেজনিক সাক্ষাৎ করেন। আলোচ্য বিষয় নিয়ে পরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র সচিব। কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এখানে আমরা গত বছরের যে ডিসকাশন, সেটার ফলোআপ কী কী আছে, সেগুলো নিয়ে আলাপ করেছি। সবার সঙ্গে আমাদের পিওরলি ডিফেন্স রিলেটেড ইস্যু যেগুলো আছে সেগুলো বাদে অন্যান্য যে সিকিউরিটি ইস্যু আছে—সাইবার সিকিউরিটি, পরিবেশ, ইন্দোপ্যাসিফিক আউটলুক, এনার্জি সিকিউরিটি, মানবাধিকারের কিছু ইস্যু; এসব নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ওনারা।’
সংলাপ ফলপ্রসূ হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা নিয়মিত এ ধরনের মতবিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমরা বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বহুমুখী যে সম্পর্ক সেটা ঘন ঘন সাক্ষাতের চাহিদা রাখে, যাতে করে কোনো ধরনের গ্যাপ সৃষ্টি না হয়। সব ব্যাপারেই যে আমাদের একমত হতে হবে তা না কিন্তু আমাদের পার্সপেকটিভটা যেন আমরা তুলে ধরতে পারি। তাদেরও এটা প্রত্যাশা। কারণ তারা চায় তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আগামীতে আরো গভীরতর হোক; সেটা ইকোনমিক সাইড, পলিটিক্যাল সাইড—সব সাইডেই।’
দি অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা) ও প্রতিরক্ষা চুক্তির অংশ হিসেবে জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া) নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হয়েছিল পররাষ্ট্র সচিবের কাছে। জবাবে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘সরাসরি আকসা জিসোমি নিয়ে কোনো আলাপ হয়নি। সেটা একটা প্রতিরক্ষা সংলাপের ইস্যু, সেটা সেখানেরই প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল। তবে আমরা বলেছি, আমাদের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সিমিলার চুক্তি নিয়ে কাজ হচ্ছে। আপনারা জানেন, জাপানের সঙ্গে আমরা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে উন্নীত করেছি। জাপানও আমাদেরকে কনসিডার করেছে, ওডিএর আলোকে যে সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স সেটাতে আমাদের তারা ক্যান্ডিডেট কান্ট্রি করেছে। সুতরাং আমরা বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছি। আগামীতে হয়তো তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) ব্যাপারেও, সামনে আমাদের আলোচনাও আছে তাদের সঙ্গে। সুতরাং এভাবে আলোচনায় এসেছে।’
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা—এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘র্যাবের (নিষেধাজ্ঞা) প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা যেটা বলেছি, মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত অভিযোগ এবং যে প্রতিবেদন আসে প্রতিটাকে আমরা সিরিয়াসলি নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করে সেগুলোর উত্তর বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দিই। আমাদের দেশে আমরাও দায়মুক্তির কোনো সুযোগ রাখি না। প্রত্যেকটা আর্মড ফোর্সেস যেগুলো আছে র্যাব, পুলিশ—তাদের প্রত্যেকেরই এসওপি আছে, একটা গুলি খরচ করলে সেটারও একটা জবাবদিহিতা আছে, সুতরাং আমরা সেগুলো সবসময় করি।’
কোনো দুর্ঘটনা বা যেকোনো ধরনের অভিযোগে সবসময় সরকার সম্পৃক্ত থাকে তা না জানিয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘কিছুদিন আগে দেখেছি, গাজীপুরে একজন শ্রমিক নেতা মারা গেছেন। সেখানে সরকারের করার কিছু ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদেরকেই জবাবদিহিতা করার একটা ব্যাপার থাকে। আমরা সেটা বলেছি, অনেক সময় লোকাল, ১৭ কোটি মানুষের দেশ, সেখানে এক এক জায়গায় এক এক ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো খবর পাই, তাৎক্ষণিক তাদের এসওপি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা হওয়ার মতো ঘটনা এখানে আছে। সুতরাং আমরা র্যাবের ব্যাপারে অবশ্যই বলেছি, ওদের যে সিস্টেম আছে ওফ্যাকের (ওএফএসি) সেখানে আমাদের যে এক্সপ্লানেশন বা রিটেন সাবমিশন, সেটা দেয়া হয়েছে। এখন ওটা ওদের প্রসেসের মধ্যে আছে। প্রসেসের মধ্য দিয়েই যেতে হবে।’
ব্যাখ্যায় তারা সন্তুষ্ট কিনা, তারা কী বলেছে এবং আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছে কিনা—এসব প্রশ্নের জবাবে জ্যেষ্ঠ এ সচিব বলেন, ‘আইনি লড়াই বা ওদের যে অফিশিয়াল সিস্টেম সেগুলো করতেই হবে। আমরা অফিশিয়ালি বলেছি, আমরা সজাগ আছি এবং আমাদের এখানে দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।’ পাশে থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা উইংয়ের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম তখন বলেন, ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি এবং রিফর্ম এ দুটির ব্যাপারে তারা মনোযোগ দিচ্ছে।’ এরপর পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমরা ডিউ প্রসেসটা ফলো করছি কিনা ওটাই তারা গুরুত্ব দিয়েছে।’
র্যাবের জবাবদিহিতা ও সংস্কার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘র্যাব নিয়ে অত বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। আমরা চেয়েছি, আমাদের বিভিন্ন বাহিনীর যে ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ে যে সহযোগিতা সেটা যেন অব্যাহত থাকে। র্যাবের ওপর আপাতত তাদের রেস্ট্রিকশন আছে। আমাদের পুলিশ বাহিনী আছে, নির্বাচন কমিশন আছে, আমাদের বিজিবি, কোস্টগার্ড আছে, এদের সবার সঙ্গে সহযোগিতা আছে। আমাদের আর্মি টু আর্মি বিভিন্ন রকম জয়েন্ট এক্সারসাইজ, সেগুলো অব্যাহত থাকবে। আগামীতে আরো জোরদার করা হবে।’
নির্বাচন, মানবাধিকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সামগ্রিক নিরাপত্তার মধ্যে যদি আমরা মানুষের নিরাপত্তাকে সম্পৃক্ত করি তাহলে তো মানবাধিকার এসেই যায়। সে ব্যাপারে আমাদের যে অবলিগেশন আছে সেগুলো আমরা যে ফুলফিল করছি আন্তর্জাতিকভাবে বা আমাদের জাতীয়ভাবে সেটা আমরা পুনর্ব্যক্ত করেছি। নির্বাচনের ব্যাপারে জানতে চেয়েছে বা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমরা বলেছি, আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, বিদেশীদের কাছেও বলেছেন। ইলেকশন কমিশন বাকি কাজগুলো এখন করছে। ক’দিন আগে প্রশিক্ষণের একটা কর্মসূচি ছিল, ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়েও তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) যদি কোনো সাহায্য লাগে, সেটা তারা করতে রাজি আছে বা করতে চেয়েছে। যে ধরনের প্রস্তুতি হওয়া দরকার সেগুলোই হচ্ছে। এখন রাজনৈতিক দল কে কী ভাবছে সেটা আমরা বলতে পারব না।’
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের সর্বশেষ অবস্থান আমরা তুলে ধরেছি, আমরা এটার সমাধান চাই। একদিকে যেমন মানবিক কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখা উচিত, অন্যদিকে আমাদের এখানে যে বিশাল জনগোষ্ঠী ১১ লাখের বেশি, তাদেরকে কীভাবে ফিরিয়ে নেয়া যায়, সে বিষয়ে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি। তাদের কিছু অবজারভেশন আছে, রাখাইনে এখন নিরাপত্তা পরিস্থিতি কেমন, টেকসই জীবন-জীবিকার কি ব্যবস্থা আছে, সেগুলোর ব্যাপারে তাদের কিছু অবজারভেশন থাকতে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রের তিন হাজার রোহিঙ্গা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আমরা কাজ করছি। আশা রাখছি অক্টোবর বা এ বছরের মধ্যে যাবে। ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক নিয়ে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘তারা আমাদের ইন্দোপ্যাসিফিক আউটলুক আমলে নিয়েছি এবং সেখানে অনেক মিল আছে। আমাদের যে প্রত্যাশাগুলো আছে, আমাদের এ ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রি নেভিগেশন হয়, এখানে ইকোনমিক যে সমস্ত পোটেনশিয়াল আছে সেগুলো যাতে পুরোপুরি ইউটিলাইজ করা হয়, সেগুলোর ব্যাপারে তারাও একমত। তারাও চায় না, কোনো একটা পার্টিকুলার দেশ এখানে আধিপত্য বিস্তার করুক বা এখানে ফ্রি নেভিগেশনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াক।’
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের সম্পর্ক। উনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কল অন করবেন। সাম্প্রতিক যে আন্তর্জাতিক বিশ্বের যেসব কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের পর থেকে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। সার এবং জ্বালানি নিরাপত্তা, স্যাংশন, আমাদের যে সমস্যা আছে সেগুলো আমরা তুলে ধরব। রাশিয়াকে আমরা নিশ্চয়ই অনুরোধ করতে পারি যেন দ্রুত শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করা যায়।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ