ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে শাহজালাল বিমানবন্দরে ই-গেট। যা দিয়ে একজন যাত্রী মাত্র ১৮ সেকেন্ডে নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। উদ্বোধনের ১১ মাস ৮ দিন পর বিমানবন্দরে ই-গেট গত বছরের ৬ই জুন পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ব্যবহার করা হয়।
পরে পুরোপুরি চালু হলেও পুনরায় অনেকটা অচল এবং অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ৪ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প তেমন কাজে আসছে না বলে জানিয়েছে বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বিমানবন্দরের ডিপার্চার (বহির্গমন) এলাকায় মোট ১২টি এবং অ্যারাইভাল (আগমনী) এলাকায় ৩টি ই-গেট স্থাপন করা হয়েছে। ই-পাসপোর্টধারীরা ভেরিফিকেশন শেষে ই-গেট দিয়ে যেতে পারেন। পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের মতে, ই-পাসপোর্টধারী যাত্রী ১৮ সেকেন্ডের মধ্যে ভেরিফিকেশন শেষে ই-গেট অতিক্রম করতে পারেন।
এক্ষেত্রে প্রথমে পাসপোর্টের ডিজিটাল ছবিযুক্ত পৃষ্ঠা ই-গেটের মনিটরের সামনে ধরলে ১০-১৫ সেকেন্ডের মধ্যে কাঁচের দরজা খুলে যাবে। নির্দিষ্ট নিয়মে গেটের নিচে দাঁড়ানোর পর ক্যামেরা ছবি তুলে নেবে।
এরপর সব ঠিকঠাক থাকলে ই-গেট দিয়ে ঢুকে স্ক্যানিং গেটের সামনে দাঁড়ালে ৫-৬ সেকেন্ডের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ই-পাসপোর্টের যাবতীয় তথ্য যাচাই শেষে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সঠিকভাবে ই-পাসপোর্ট ব্যবহারে সহযোগিতা করবেন। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ ডিআইপি সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২২শে মার্চ ই-পাসপোর্ট উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি নাগরিককে ই-পাসপোর্ট দিয়েছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাসে প্রায় গড়ে ৫ লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত ১ কোটি ই-পাসপোর্টের বিপরীতে মাত্র ১ লাখ ১৫ হাজার যাত্রী ই-গেট ব্যবহার করেছেন। সে হিসাবে মোট যাত্রীর ২ শতাংশ ই-গেট ব্যবহার করেছেন। আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরে স্থাপন করা হয়েছে জার্মানির অত্যাধুনিক ২৭টি ই-গেট।
সেটি উদ্বোধনের পর ইমিগ্রেশনের জন্য যাওয়া যাত্রীরা কিছুদিন ব্যবহারও করেন। এরপর শুরু হয় কেন্দ্রীয় ই-পাসপোর্টের সঙ্গে ই-গেটের সার্ভার জটিলতা। অনেক ই-পাসপোর্টধারী যাত্রী বিমানবন্দরে বহির্গমনের সময় ই-গেট বন্ধ দেখতে পান।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া-দুবাইসহ কয়েকটি দেশে ভ্রমণে যাওয়া এবং ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরার পথে ই-গেট মেশিন নষ্ট দেখতে পান বলে জানিয়েছেন বেসরকারির সংস্থার এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১৮ সেকেন্ডের ইমিগ্রেশন সেবা পাওয়ার আশায় খুব আগ্রহ নিয়ে ই-গেটের কাছে যাই। ইমিগ্রেশনের ই-গেটের স্ক্রিনে নীল আলোর পাশেই বড় পর্দায় লেখা এ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে দ্রুতই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হবে।
অথচ বিদেশে যাওয়া এবং দেশে ফেরার সময় ই-গেট দিয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখি মেশিন নষ্ট। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত একজন জানান যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে ম্যানুয়ালি ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে বহির্গমন করেন।
পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, তাদের ই-গেট কার্যক্রম চালু রয়েছে। সেটা শুধুমাত্র ই-পাসপোর্টধারী যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারবে। মাঝেমধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ই-গেট সেবা বন্ধ থাকলেও এর কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ওদিকে কেন্দ্রীয় ই-পাসপোর্টের সঙ্গে ই-গেটের সার্ভারের সংযোগ জটিলতার বিষয়টির কথা জানিয়েছে ইমিগ্রেশন সূত্র।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ এখনো ই-গেট ব্যবহার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ পায়নি। তাই ভবিষ্যতে ইমিগ্রেশনে ই-গেট ব্যবহার করা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিভিল এভিয়েশন) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, ই-গেট সেবা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ই-গেট সেবা সম্পর্কে জানতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী এমপিকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। ইমিগ্রেশন পুলিশ সূত্র জানায়, মাত্র ১৮ সেকেন্ডে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয় তথ্যটি সঠিক নয়। ই-গেট অতিক্রম হওয়ার পর রেগুলার প্রসেসের অংশ হিসেবে ইমিগ্রেশন ডেস্কে ভিসা ও অন্যান্য তথ্য যাচাই করা হয়। ই-গেট এর কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র পাসপোর্টধারী যাত্রী একই ব্যক্তি কিনা তা শনাক্ত করা। বাকি কাজ আগের মতোই মেনুয়ালি করতে হয়। ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাদাত হোসেন বলেন, ই-গেট তো চলছে। বন্ধ নয়। গ্রাহক সেবা চলমান রয়েছে। ই-গেট শুধুমাত্র ই-পাসপোর্টধারীরা ব্যবহার করতে পারবেন। এমআরপিটা মেনুয়ালি করা হয়। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ১ কোটি মানুষকে ই-পাসপোর্ট দিয়েছি। সংখ্যায় যেহেতু কম তাই এটার ব্যবহারকারীও কম। ইতিমধ্যে অনেক যাত্রীর কাছ থেকে অভিযোগ শুনেছি বিমানবন্দরে ই-গেটে দায়িত্বরত সদস্যরা যাত্রীদের এটা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাদাত হোসেন বলেন, হয়তো বা ই-গেটে কর্মরত ব্যক্তিরা এখনো প্রযুক্তিটিকে সহজভাবে নিতে পারছেন না। হঠাৎ করে নতুন প্রযুক্তি দেখলে কিছুটা সংশয় দেখা দিতে পারে। অনেকে ভয়ও পেতে পারেন মেশিনে আটকে যাবে কিনা। এছাড়া তিন থেকে চার কোটি লোকের কাছে ই-পাসপোর্ট চলে আসবে তখন ই-গেট ব্যবহার করার বিষয়টি সাবলিল হয়ে যাবে।
ই-গেট এর মেশিনারিজ নষ্ট কিনা জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, নষ্ট হলে তো আমাদের ইঞ্জিনিয়ার আছেন। অনেকগুলো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র বসানো আছে। হতে পারে তার কোনো একটি নষ্ট হয়েছে। কিংবা অনেক সময় টেকনিক্যাল পাওয়ার আপ-ডাউন হতে পারে। আমাদের সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষিত লোক রয়েছে। তাদেরকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয় না কোনো জটিলতা আছে। আমাদের ৮০টি মিশনে তিনটি এয়ারপোর্ট ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চট্টগ্রাম এবং সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তিনটি এয়ারপোর্ট এবং দুটি ল্যান্ডপোর্ট বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দর নিয়ে কাজ করছি। এই পাঁচটি পোর্টে ই-গেট রয়েছে। এবং ২২টি চেকপোস্টে নরমাল অন্য অটোমেটিক সিস্টেম চালু রয়েছে।
এখন পর্যন্ত আমরা তিনটি বিমানবন্দরে সফলভাবে ঢাকায় ২৮টি, চট্টগ্রামে ৬টি এবং সিলেট ওসমানীতে ৬টি ই-গেট চালু করেছি। বেনাপোলে ৪টি এবং বাংলাবান্ধে ২টি ই-গেট স্থাপন করা হয়েছে। সবগুলোই সচল আছে। ই-গেট সেবা পরিচালনায় এসবি’র সদস্যদের দেশের অভ্যন্তরে ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বিদেশে ৫ জনকে। আরও অনেককে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশেও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
আপনার মতামত জানানঃ