২০২০ সালের পুরোটাই বলতে গেলে মানুষের করোনা আতঙ্কে কেটেছে। এরমাঝে ভাইরাস তীব্র আকার ধারণ করলে বছরের অধিকাংশ সময়টাই মানুষের কেটেছে ঘরে। রাস্তাঘাটেও ছিলো না পূর্বেকার মতো মানুষের তেমন কোনো চাপ। তবুও বিগত বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন চার হাজার ৯৬৯ জন এবং পাঁচ হাজার ৮৫ জন আহত হয়েছেন। আজ বুধবার(০৬ জানু) জাতীয় প্রেসক্লাবে ২০২০ সালের সড়ক দুর্ঘটনার এ পরিসংখ্যান তুলে ধরেন নিসচার(নিরাপদ সড়ক চাই) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন, টেলিভিশন ও অনলাইন পত্রিকার প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সংগঠনটির চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, গত বছর মোট ৪ হাজার ৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় অন্তত ৪৯৬৯ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৮৫ জন আহত হয়েছেন।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে ৪৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৯৫ জন নিহত ও ৮২৩ জন আহত হয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ৩৬৫টি দুর্ঘটনায় ৪৩৭ জন নিহত ও ৭৬২ জন আহত, মার্চে ৩৭৯টি দুর্ঘটনায় ৪৫৪ জন নিহত ও ৭৬৭ জন আহত, এপ্রিলে ১৩২টি দুর্ঘটনায় ১৩০ জন নিহত ও ১২০ জন আহত, মে মাসে ১৯৬টি দুর্ঘটনায় ২৪২ জন নিহত ও ২০৬ জন আহত, জুন মাসে ২৬০টি দুর্ঘটনায় ৩৩০ জন নিহত ও ২৩৩ জন আহত। জুলাই মাসে ২২০টি দুর্ঘটনায় ২৮৪ জন নিহত ও ১৯৭ জন আহত, আগস্ট মাসে ৩৪০টি দুর্ঘটনায় ৪৮৩ জন নিহত ও ৪২৩ জন আহত, সেপ্টেম্বরে ২১৬টি দুর্ঘটনায় ২৫০ জন নিহত ও ৪০৪ জন আহত, অক্টোবরে ২৩০টি দুর্ঘটনায় ২৬২ জন নিহত ও ৩৮৭ জন আহত, নভেম্বরে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩১৬ জন নিহত ও ৩৭২ জন আহত এবং ডিসেম্বর মাসে ৩৬৩টি দুর্ঘটনায় ৪৫৮ জন নিহত ও ৩৯১ জন আহত হয়েছেন। এর বাইরে ৬৮২টি দুর্ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি ও রিলিজের পরে ৮২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়া, রেলপথে ১০৮টি দুর্ঘটনায় ১২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৩১ জন। ৭০টি নৌ দুর্ঘটনায় ২১২ জন নিহত এবং এক শ জন নিখোঁজ হয়েছেন গতবছর।
এদিকে ২০১৯ সালে মোট চার হাজার দুইটি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২২৭ জন নিহত ও ৬ হাজার ৯৫৩ জন আহত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৩৯ জন নিহত ও ৭ হাজার ৪২৫ জন আহত হন।
নিসচার প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে, গত বছরের জানুয়ারি মাসে বেশি ৪৪৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৪৯৫ জন নিহত ও ৮২৩ জন আহত হন। আর এপ্রিল ও মে মাসে সবচেয়ে কম যথাক্রমে ১৩২ ও ১৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে।
এর পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশে লকডাউন থাকায় দুর্ঘটনা কম হয়েছে।
ইলিয়াস কাঞ্চন লিখিত বক্তব্যে জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ এলাকায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) এলাকায় কম দুর্ঘটনা ঘটে।
তিনি দাবি করেন, এসব এলাকায় চালকরা তুলনামূলক কম গতিতে নিয়ন্ত্রণে রেখে যানবাহন চালানোর কারণে দুর্ঘটনা কম হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রদত্ত ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো, লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা, বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি, মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন চলাচল এবং রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট থাকা।
সড়ক আইনের সঠিক বাস্তবায়ন হলে সড়ক নিরাপদ হয়ে উঠবে বলেও মন্তব্য করেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
লিখিত বক্তব্যে সুপারিশ তুলে ধরে বলা হয়, হাইওয়েতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ তত্ত্বাবোধনে উচ্চপর্যায়ের মনিটরিং সেল গঠন করে তাদের মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মহাসড়কের যাবতীয় বিষয়গুলো মনিটরিং করতে হবে। করোনা নিয়ে সরকারিভাবে যেরকম প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।বিভিন্ন মিডিয়া মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকা রুট ফ্রান্সাইজের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্র-তত্র গাড়ি পার্কিং করা, নির্দিষ্ট স্থান ব্যতিরেকে যেখানে-সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানো, ওভার টেকিং করা, পাল্টা-পাল্টি ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই করা, গাড়ির ছাদে যাত্রী বহন করা, ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস বা জেব্রাক্রসিং থাকা সত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করার প্রবণতাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সুপারিশে আরও বলা হয়, সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘সেইফ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৪১০ জন গাড়ি চালক প্রশিক্ষক তৈরি ও ৩ লাখ গাড়ি চালকদের আপগ্রেডিংয়ের জন্য ১২ ও ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে লাইসেন্সবিহীন চালকরা ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে বৈধ লাইসেন্সের আওতায় আসবে এবং হালকা ও মধ্যম গাড়ির চালকরা ১২ দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ ভারী গাড়ির লাইসেন্স পাবে, যা দেশে দক্ষ চালক সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে।
নিসচার সুপারিশে আরও রয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল মহাসড়কের মতো সব মহাসড়ক এবং প্রধান সড়কে একমুখী চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়ে দীর্ঘ এবং উচ্চতা সম্পন্ন সড়ক বিভাজন তথা রোড ডিভাইডারের ব্যবস্থা করতে হবে। সব মহাসড়ক এবং প্রধান সড়ককে অবশ্যই ন্যূনতম চারলেনে উন্নীত করতে হবে। পথচারীদের নিবিঘ্নে চলাচলের জন্য ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করে যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে ফুটপাত তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় যেন ফুটপাত দখল না হয় এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সড়কের ত্রুটিগুলো অচিরেই দূর করতে হবে।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ