বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ‘সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আগামী শুক্রবার ঢাকায় দুটি গণমিছিলের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে এবং এ ঘোষণা অনুযায়ী বিএনপির সাথে আন্দোলনে থাকা জোট ও দলগুলোও একই কর্মসূচি পালন করবে।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমন সময় নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করলেন যখন গত ২৯শে জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি পালন নিয়ে সমন্বয়হীনতার অভিযোগে রীতিমত দলীয় হাইকমান্ডের ‘তোপের মুখে আছেন’ একদল নেতা।
এর জের ধরে এর মধ্যেই একটি সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদ হারিয়েছেন একজন নেতা। এছাড়া আরও কয়েকজনকে মৌখিকভাবে ‘তিরস্কার’ করা হয়েছে দলীয় হাইকমান্ডের দিক থেকে।
ফলে আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে, এমন আলোচনা জোরেশোরেই চলছে দলের মধ্যে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ওই কর্মসূচির পর সহযোগী সংগঠনগুলোর সাথে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে কর্মসূচি সফল করার জন্য ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনুপস্থিতি ও সমন্বয়হীনতার’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই।
২৮ শে জুলাই নয়াপল্টনে জনসভায় হাজার হাজার নেতা-কর্মী যোগ দিলেও ঠিক এর পরদিন ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে সেটি দেখা যায়নি। এজন্য বিএনপির নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, কেন কর্মসূচি সফল করা যায়নি?
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মনে করেন, দলের নেতাদের কারও ‘সদিচ্ছার অভাব ছিলো না, কিন্তু সমন্বয়হীনতার’ বিষয় ছিলো।
“অনেকে হয়তো নানা বাস্তব কারণেই যথাসময়ে নির্ধারিত স্পটে আসতে পারেনি। কিন্তু একটি ঘটনার পর অন্য কেউ হাল ধরে বাকীদের সাথে সমন্বয় করতে পারেনি। গাবতলীর ঘটনাই দেখুন। আমান সাহেব আটক হওয়ার পর আর কেউ দায়িত্ব নিয়ে অন্যদের সাথে কমিউনিকেট করেনি।”
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ২৯শে জুলাইয়ের কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে প্রথমে পুলিশের হামলায় আহত এবং পরে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে মধ্যাহ্নভোজন করে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলেন।
ওই দিন গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাড়া সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আমান উল্লাহ আমানকে সক্রিয় দেখা গেছে। তিনিও অসুস্থ হয়ে পরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তার খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রতিনিধি দল।
এর বাইরে দলের ওইদিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অনেককেই ‘যেখানে থাকার কথা সেখানে দেখা যায়নি’ বলে বলছেন দলের নেতারাই। বিএনপি একাধিক নেতার সাথে আলাপ করে জানা গেছে এবার ২৮শে জুলাইয়ের জনসভার ঠিক পরদিন ২৯শে জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থানের কর্মসূচি দেয়ার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো যাতে করে ‘বিপুল সংখ্যক কর্মী সমর্থকদের উপস্থিতিতে আরেকটি বড় ধরণের শো-ডাউন’ দেয়া সম্ভব হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি।
পরে ৩১শে জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আমান উল্লাহ আমান তার ভাষণে দলের স্থায়ী কমিটির সব সদস্যদের প্রতিও দলীয় কর্মসূচির সময়ে রাজপথে নেমে আসার আহবান জানান।
দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক থেকে পুরো কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভারতের শিলং এ থাকা স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার প্রবেশমুখগুলোর কে কোথায় অবস্থান করবেন এবং প্রথম দিকে কেউ বাধাপ্রাপ্ত হলে পরবর্তীতে কারা এগিয়ে যাবেন -তেমন পরিকল্পনা করে দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছিল।
নেতাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দলের সিনিয়র নেতারা মূল পয়েন্টগুলোতে থাকবেন কিন্তু জমায়েত সফল করা এবং প্রয়োজনে ‘বাধার মুখে টিকে থাকার’ জন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা এবং ঢাকা মহানগরের নেতাদের ওপর ভরসা করা হলেও সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি এসব নেতাদের সক্রিয় উপস্থিতি না থাকায়।
নাম না প্রকাশের অনুরোধে একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ক্ষুব্ধ করেছে, যার বহি:প্রকাশ ঘটেছে পরে সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে তার বৈঠকে।
এর আগে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা অবস্থান কর্মসূচির দিনে কে কোথায় ছিলেন সে সম্পর্কিত ভিডিওগুলো সংগ্রহ করেন ও খোঁজ-খবর নেন। এ পরিস্থিতিতে ‘দ্রুত নিজেদের মধ্যে ঝামেলা’ মিটিয়ে ফেলার জন্য দলীয় নেতাদের তিনি অনুরোধ করেছেন বলে জানা গেছে।
এছাড়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন-এমন কয়েকজনের সঙ্গে নিজেও কথা বলে তার অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন, যা নিয়ে এখন দলের অভ্যন্তরে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের একজন রুহুল কুদ্দুস তালুকদার অবশ্য বলছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখী অবস্থানসহ নানা বাস্তব কারণে অনেকে চেষ্টা করেও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না অনেক সময়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এটি দলের মধ্যে কোনো হতাশা তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, সিনিয়র নেতারা অনেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ, যাদের পক্ষে মাঠে নামা কঠিন। কিন্তু তাদের নেতৃত্বও দলের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
“রাজনৈতিক দলে এটি স্বাভাবিক চিত্র। দল নিয়মিতই অবস্থা পর্যালোচনা করছে ও করবে। অনেক সময় কৌশলও পাল্টাতে হয়। অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আমাদের কর্মী সমর্থকরা এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।”
তবে ওই কর্মসূচির এক সপ্তাহের মাথায় ছাত্রদল সভাপতির পদ থেকে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে ‘অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে’ সরিয়ে দেয়ার ঘটনা নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে।
তাকে ‘অসুস্থ’ বলা হলেও মূলত তাকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশের সময়েও তিনি দলীয় কার্যালয়ে সুস্থই ছিলেন বলে জানা গেছে।
এরপরই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ২৯শে জুলাইয়ের কর্মসূচিতে যারা নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেননি তাদের বিরুদ্ধে ‘সাংগঠনিক ব্যবস্থা’ এভাবেই নেয়া হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের সাথে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার অবশ্য বলছেন, “দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের স্বার্থে যে কাউকেই তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারেন বা কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন”।
কিন্তু নেতারা যা-ই বলুন না কেন দলের অভ্যন্তরে এখন বড় আলোচনার বিষয় হলো – জনসভাগুলোতে বিপুল উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলেও ‘বাধা আসতে পারে এমন কর্মসূচি’তে নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের আনা যাচ্ছে না কেন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলছেন, জনসভাগুলো শান্তিপূর্ণ হয় বলে সেখানে সব বয়সের মানুষ উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু যেসব কর্মসূচিতে ‘পুলিশ বা সরকারি দলের হামলার’ সম্ভাবনা থাকে সেখানে সেটা সম্ভব হয় না।
“সবাইতে সব কর্মসূচিতে থাকতে পারবে না। তবে এখন যে সমন্বয়হীনতার দেখা যাচ্ছে সেটার যৌক্তিক কারণও আছে। অনেক মামলার কারণে আত্মগোপনে। ফোনে কথা বলাও রিস্ক হয়ে যায় অনেক সময়।”
তবে নেতাদের আশা বিষয়টি এবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নজরে আসায় এবং দল থেকে কড়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার ইঙ্গিত আসার কারণে তাদের সামনের কর্মসূচিগুলো আরও সুসংগঠিত হবে এবং তাতে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের অংশগ্রহণও বাড়বে।
এসডব্লিউএসএস/০৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ