ঠিক কবে থেকে এই পেঁয়াজের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল কিংবা ঠিক কবে থেকে রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রচলন ঘটে তা সঠিক জানা যায়নি। মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগের কিছু মানববসতিতে সবজি হিসাবে পেঁয়াজের ব্যবহারের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে।
আরেক দল গবেষকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের চাষ করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। সহজেই নানা জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, ধীর পচনশীলতা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য।
ইতিহাস ঘেঁটে বিয়েতে পেঁয়াজ উপহার দেয়া-নেয়ার নজীর মিলেছে খ্রীস্টপূর্ব ৫১ শতাব্দিতে রোমান সাম্রাজ্যে। মুদ্রার পরিবর্তে রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা কর ও ভাড়া পরিশোধ করতে পারতেন পেঁয়াজ দিয়ে। পেঁয়াজের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে গিয়ে অনেকের চোখের পানি- নাকের পানি এক হলেও এর উপকারী গুণ ও আরোগ্য ক্ষমতা অবিশ্বাস্য! আর মসলা হিসাবে পেঁয়াজের গুরুত্ব অভাবনীয়। প্রাচীন গ্রিক, রোমান কিংবা মিসরীয়দের মধ্যে মশলা এবং ঔষধী হিসেবে পেঁয়াজ ছিল অন্যতম। প্রাগৈতিহাসিককাল হতে পেঁয়াজের আবেদন থাকলেও ধর্মীয় কারনে ভারতবর্ষে পেয়াজ জনপ্রিয়তা পেতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, পৃথিবীতে যখন কৃষি কাজের প্রচলন হয়নি সেই সময়েও খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাগৈতিহাসিক লোকেরা কৃষিকাজ উদ্ভাবনের অনেক আগে থেকেই বুনো পেঁয়াজ খেতেন। প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতো মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য পেঁয়াজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের সমাধির মধ্যে তারা পেঁয়াজ রাখতো। এই ঘটনার সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা চতুর্থ রামেসিসের সমাধিতে। সেটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর দেখা যায়, রাজা চতুর্থ রামেসিসের মমির দুই চক্ষু কোটরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে পেঁয়াজ! এছাড়াও মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে পেঁয়াজ রাখা হতো। বুকে পেঁয়াজের ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। মমির কান, পায়ের পাতা ইত্যাদি প্রত্যঙ্গ পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হতো। বহু মিশরীয় পিরামিডের ভিতরের নানা চিত্রকর্মেও পেঁয়াজের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মিশরীয়রা পেঁয়াজকে জাদুকরী বস্তু মনে করতো।
তবে প্রাচীন মিশরীয়দের তুলনায় প্রাচীন গ্রিকরা পেঁয়াজের ব্যবহারে ছিল কয়েক ধাপ এগিয়ে। তারা পেঁয়াজের বহু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফলে প্রাচীন গ্রিসের ক্রীড়াবিদরা প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খেতো। এছাড়াও নিজেদের পেশী আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে রোমান গ্লাডিয়েটররা তাদের শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতো। রোমানরাও পেঁয়াজের নানা উপকারী দিক সম্পর্কে জানতো। তারা দাঁতের ব্যথা কিংবা অনিদ্রা দূর করতে পেঁয়াজ খেতো। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্নুত্পাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে।
সেখানেও প্রত্নতত্মবিদরা পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। বাইবেলেও ইসরাইলিদের পেঁয়াজ খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে পেঁয়াজকে দেখা হতো ‘সুপার-ফুড’ হিসাবে। সেসময় মানুষ মুদ্রার মতো পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। নানা কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে কিংবা ভাড়া পরিশোধ করার ক্ষেত্রেও পেঁয়াজের প্রচলন ছিল। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন বিয়েতে মানুষ বর-কনেকে পেঁয়াজ উপহার দিতো।
আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও মেটাতো পেঁয়াজ। যখন সব পুষ্টিকর খাদ্য ফুরিয়ে যেত সেসময় খাওয়ার জন্য আগে মানুষ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতো।
এসব কারণে পেঁয়াজ যে খুবই জনপ্রিয় একটি খাদ্য ছিল তা কিন্তু বলাই যায়। সেই সুদূর পূর্ব থেকে প্রাচীন মিশর অব্দি, পৃথিবীর বহু দেশে বহু সংস্কৃতিতে পেঁয়াজের ব্যবহারের বহু দলিল ইতিহাস ঘাটলেই পাওয়া যায়। সেই সাথে মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর বহু স্থানে এই পেঁয়াজকেই অনন্ত জীবনের প্রতীক হিসাবে দেখা হতো। পেঁয়াজের গোলাকার আকৃতি ও এর সমকেন্দ্রিক একটির উপর আরেকটি চক্রাকার রিং থেকে এই ধারণার জন্ম বলে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, প্রাচীনকালে মানুষের কাছে পেঁয়াজের ছিল বিশেষ গুরুত্ব। প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে পেঁয়াজ ছিল পূজনীয় বস্তু। বহু মিসরীয় পিরামিডের ভিতরের নানা চিত্রকর্মে পেঁয়াজের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বহু মিশরীয় যাজকদেরকেও ছবিতে পেঁয়াজ হাতে দেখা গিয়েছে।
পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ কি আপনার অপছন্দ? তবে জেনে রাখুন, কিছু মিশরীয়দের ধারণা ছিল পেঁয়াজের এই ঝাঁঝালো গন্ধ ও তার জাদুকরী ক্ষমতায় মৃত মানুষ আবার নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু করে। গবেষকদের মতে, এমন ধারণার পিছে কারণ হলো, পেঁয়াজের ঔষধি গুণ। পেঁয়াজের ঔষধি গুণের কারণে নানা অসুখ ভালো হতো। ফলে মিশরীয়রা পেঁয়াজকে জাদুকরী বস্তু মনে করতো।
তবে প্রাচীন মিশরীয়দের তুলনায় প্রাচীন গ্রিকরা পেঁয়াজের ব্যবহারে ছিল কয়েক ধাপ এগিয়ে। তারা পেঁয়াজের বহু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফলে প্রাচীন গ্রিসের ক্রীড়াবিদরা প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ খেতো। এছাড়াও নিজেদের পেশী আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে রোমান গ্লাডিয়েটররা তাদের শরীরে পেঁয়াজ মালিশ করতো।
রোমানরাও পেঁয়াজের নানা উপকারী দিক সম্পর্কে জানতো। তারা দাঁতের ব্যথা কিংবা অনিদ্রা দূর করতে পেঁয়াজ খেতো। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্নুৎপাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে। সেখানেও প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ। বাইবেলেও ইসরাইলীদের পেঁয়াজ খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।
মধ্যযুগে পেঁয়াজকে দেখে হতো ‘সুপার-ফুড’ হিসাবে। সেসময় মানুষ ঠিক মুদ্রার মতো পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। নানা কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে কিংবা ভাড়া পরিশোধ করার ক্ষেত্রেও পেঁয়াজের প্রচলন ছিল। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন বিয়েতে মানুষ বর-কনেকে পেঁয়াজ উপহার দিতো। মধ্যযুগে ইউরোপীয় রান্নার প্রধান তিন উপাদান ছিল শিম, পেঁয়াজ ও বাঁধাকপি। ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাই খাবারে পেঁয়াজ ব্যবহার করতো।
ইতিহাসে ওষুধ হিসাবেও পেঁয়াজের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে ষোড়শ শতাব্দীতে ওষুধ হিসাবে পেঁয়াজের কিছু অদ্ভুত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। যেসব মহিলার সন্তান জন্ম দিতে সমস্যা দেখা যেত কিংবা যাদের কোনো ছেলেমেয়ে হতো না তাদেরকে বিশেষভাবে পেঁয়াজ খেতে দেওয়া হতো। মাথাব্যথা উপশমের জন্য পেঁয়াজের ব্যবহার ছিল বহু প্রচলিত। এছাড়া সাপের কামড় ও চুল পড়া রোধে পেঁয়াজ ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হতো।
ভারতে পেঁয়াজ জাতে উঠেছিল মোগল ও সুলতানি আমলে। বিশেষ করে মুসলমানদের হাত ধরে। ইবনে বতুতার লেখায় আছে, তেরো শতকে দিল্লির সুলতানের দরবারে ভাজা পেঁয়াজের পুর দেয়া সমুচা খুব জনপ্রিয় ছিল। আর ‘আইন-ই আকবরি’তে লেখা সব পদেই পেঁয়াজের ছড়াছড়ি। এখান থেকেই ধাপে ধাপে পেঁয়াজ এ দেশের সাধারণ মানুষের হেঁশেলে ঢুকে পড়ল। দিল্লির সুলতানদের রাজকবি আমির খসরু লিখেছেন, ১৩০০ সালের দিকে মাংস, ঘি আর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি সমুচা রাজকুমাররা ও তাদের পর্ষদগণ ভীষণ উপভোগ করে খেতেন!
ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। সহজেই নানা জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, ধীর পচনশীলতা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল অতি প্রয়োজনীয় একটি খাদ্যপণ্য। আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, পানির মতো প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও নাকি মেটাতো এই পেঁয়াজ!
ষোড়শ শতাব্দীতে মানুষ যখন আটলান্টিকের অন্য পাশের উন্নত জীবন ও জীবিকার আশায় পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে পাড়ি জমালো, তখন তারা তাদের সঙ্গে করে কিছু পেঁয়াজ নিয়ে আসতে ভোলেনি। তাদের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে জানা যায়, আমেরিকায় সেই ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমেই প্রথম পেঁয়াজের চাষ শুরু হয়। উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমানো প্রথম ঔপনিবেশিকদের প্রথম চাষ করা ফসল ছিল পেঁয়াজ। তবে, ইউরোপীয়দের আগমনের আগেই আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে পেঁয়াজের ব্যবহার চালু ছিল। তারা নানা সিরাপ, রঙ ও ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য পেঁয়াজ ব্যবহার করতো। প্রাচীনকালের বিভিন্ন গ্রন্থে পেঁয়াজকে মূত্রবর্ধক, হজমে সহায়ক, হূদপিন্ড ও চোখের জন্য উপকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এসব বর্ণনার সত্যতা মিলছে বর্তমানের আধুনিক নানা গবেষণাতেও।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৩০
আপনার মতামত জানানঃ